দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতির নাম মালয়েশিয়া। দেশটি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি অনুকরণীয় রাষ্ট্র। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কৃষি নির্ভর মালয়েশিয়া পরিণত হয় একটি শিল্পসমৃদ্ধ অর্থনীতিতে। প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ছিল স্বাধীনতা-উত্তর মালয়েশিয়ার মূল দর্শন। মালয়েশিয়ার দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে আছে সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনা ও উন্নত উন্নয়ন পরিকল্পনা। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ২০২০ সালের মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে মালয়েশিয়া। উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র হিসাবে মালয়েশিয়াসহ অন্য বন্ধু রাষ্ট্র পাশে থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হতে বাংলাদেশকে বেগ পেতে হবে না এমনটাই আশা বিশ্লেষকদের।

বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আর এই বন্ধু রাষ্ট্র দুটির মধ্যে বিভিন্ন বিষয় যেমন ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মত মালয়েশিয়া একটি মুসলিম প্রধান দেশ। মুসলিম প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও উভয় দেশ বিশেষ করে উদার গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের থেকে মালয়েশিয়া বহুগুণ এগিয়ে, আর এর পেছনে দীর্ঘ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বড় ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনাকাঙ্ক্ষিত বহু ঘটনার ফলে রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ এখনও কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বাদ পায়নি। দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বদ্ধ পরিকর। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে তিনি নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ভিন্ন ভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বাণিজ্যের প্রসার, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, শ্রম বাজার বিস্তৃত করা ইত্যাদি বিষয়ে কার্যকরি উদ্যোগ নিচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার।

প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মালয়েশিয়া সফর ছিল অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ এবং সফল যেখানে দ্বি-পক্ষীয় বেশকিছু বিষয়ের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে প্রায় তিন লাখসহ ছয় লাখের মতো বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি, ভিসা প্রক্রিয়া শিথিল এবং পর্যটন ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি, দুটি সমঝোতা স্মারক ও একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। জনশক্তি বিষয়ক চুক্তি বাস্তবায়ন হলে সারাওয়াক প্রদেশে ১২ হাজার বাংলাদেশির কাজের সুযোগ তৈরি হবে, যা পর্যায়ক্রমে বেড়ে ৬০ হাজারে উন্নীত হবে।

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে যে বাণিজ্য হয় সেটা ডিসপ্রপরশনেটলি ইমব্যালেন্সড। বাংলাদেশ প্রতি বছর মালয়েশিয়া থেকে প্রায় ২০০ কোটি ডলারের পণ্য কেনে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া যায় সাড়ে ১৩ কোটি ডলারের পণ্য। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, বিশেষ করে নিটওয়্যার পণ্য রপ্তানি হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই দেশটিতে। বিপরীতে আমদানি হয় জ্বালানি ও ভোজ্য তেল। বাংলাদেশে শতাধিক মালয়েশীয় কোম্পানির বিনিয়োগও রয়েছে। আলোচ্য সফরে দুই দেশই বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়ে সম্মত হয়েছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আগেই প্রস্তাব দিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ যাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের ‘ডায়ালগ পার্টনার’ হতে পারে সে ব্যাপারে মালয়েশিয়ার আশ্বাসও পাওয়া গিয়েছে।

মালয়েশিয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশের পণ্য যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে ওষুধ, পাট পণ্য, সিমেন্ট, সিরামিক, ফুটওয়্যারের বাজার খুলে দিতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন শেখ হাসিনা। নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা ১৮টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তুলছি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অবকাঠামোসহ সব ধরনের সমস্যা দ্রুত দূর করার চেষ্টা করছি। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে উপযুক্ত আইনি কাঠামো তৈরি, পুরো বিনিয়োগ সুবিধা সংস্কার, বিদেশি মুদ্রা বিনিময় নিয়ন্ত্রণ আইন শিথিল এবং বিদেশিদের বাংলাদেশে কাজের অনুমতি দেয়ার প্রক্রিয়া সহজ করাসহ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তিনি তুলে ধরেন। বাংলাদেশ সড়ক, বিদ্যুত্ ও জ্বালানি, পর্যটন, সেবা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি সরবরাহ, খাদ্য ও কৃষি এবং অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে মালয়েশিয়ার ব্যবসায়িকদের বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের বিদ্যুত্ জ্বালানি, যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে সমস্যা থাকলেও সরকার এসব চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তাকে সম্ভাবনায় পরিণত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের পর মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী দেশ বাংলাদেশ। তবে দ্বি-পক্ষীয় বাণিজ্য মালয়েশিয়া এগিয়ে আছে অনেক দূর। বিনিয়োগের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা বিশেষ করে গ্যাসের সুবিধা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “গ্যাসের চাহিদার তুলনায় সরবরাহে এখনো ঘাটতি আছে। তবে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি”। বাংলাদেশে রয়েছে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য কক্সবাজরে বিশেষ এলাকা বরাদ্দ দেয়ার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা শহরকে যাতে বিদেশের উন্নত শহরগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায় সেভাবেই গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান প্রোটনের কারখানা স্থাপনের আগ্রহ দেখিয়েছেন মাহাথির মোহাম্মদ।

বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তি হিসাবে সরকার টু সরকার (জি টু জি) সম্পর্ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জনগণ পর্যায়ের সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ। তবে জনগণ পর্যায়ের সম্পর্ক আরও বেশি শক্তিশালী করা গেলে সামগ্রিক উন্নয়ন বেশি হবে। বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার মধ্যে এইরুপ সম্পর্ক ভবিষ্যতে কার্যকর রাখতে দুই দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার মধ্যে চলমান সম্পর্কের দৃশ্যমান উন্নতি সাধন করতে অবশ্যই অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, বাংলাদেশি শ্রমিকদের বাজার সম্প্রসারণ, সামরিক সহযোগিতা, শিক্ষা বিনিময়, পর্যটন, সাংস্কৃতিক এবং বিনোদন, প্রযুক্তি বিনিময়, মানব সম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়কে অধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

 লেখক :প্রো-ভিসি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি