প্রতিদিন সংবাদপত্র কিংবা প্রচার মাধ্যমগুলোতে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক অনেক সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এসব সংবাদ আমাদের জন্যে আনন্দদায়ক ও গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামের মানুষের জীবন পাল্টে গিয়েছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। প্রযুক্তির কল্যাণে গ্রামীণ জনপদের মানুষগুলোর জীবনে তাত্পর্যপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে এবং তাদের প্রাত্যহিক জীবনেও এ পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষণীয়। মা গ্রামে বসে তার প্রবাসী ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে স্কাইপেতে কথা বলেছেন। স্ত্রী তার প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে বা স্বামীটি তার স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে কথা বলছেন এবং সবার সচিত্র ছবি দেখে মন ভরাতে পারছেন। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার বা তথ্য সেবাকেন্দ্রের বদৌলতে এ দৃশ্য এখন দেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও প্রযুক্তি সম্পর্কে গ্রামের যে মানুষগুলো বিশেষ কিছু জানতো না তারাও এখন প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে উঠেছে এসব সেন্টারের কল্যাণে। শিল্পের প্রসার হয় জীবনের প্রয়োজনে তারই সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদে।

আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া ‘ভিশন ২০২১’ প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রের যাত্রা শুরু। সম্প্রতি এটিকে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার নামকরণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। শুরুতে এসব সেন্টারে ১৩ ধরনের সেবা দেয়া হলেও এখন সেই পরিধি আরো বাড়ানো হয়েছে। গ্রামীণ জনপদে শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্যসেবা, হাট-বাজার, আইনী পরামর্শ, বিদ্যুত্ বিল প্রদান, ছেলে-মেয়ের জন্যে উপযুক্ত পাত্র-পাত্রীর সন্ধান সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যাচ্ছে এসব ডিজিটাল সেন্টারে। কিছু সীমাবদ্ধতার মাঝেও এটিকে ঘিরে ইউনিয়নের সব কার্যক্রম হয়ে উঠেছে অনলাইন কেন্দ্রিক। এতে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে তথ্যসেবা। যার কারণে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার ধরন।

সেবাদাতা এবং গ্রহীতা উভয়েই এই ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন। সরকারের এই উদ্যোগের ফলে সেবাদাতার যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সেবা গ্রহীতার সময় এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে বলে জানা যায়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দেশে এই ডিজিটাল সেন্টার ঘিরে প্রায় ১০ হাজার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হয়েছে। তারা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেরা রোজগার করছে। এই তরুণ-তরুণীদের কেউ লেখাপড়ার পাশাপাশি, কেউবা লেখাপড়া শেষ করে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করে একদিকে সমাজের মানুষের সেবা করে যাচ্ছে, অন্যদিকে নিজের ও পরিবার প্রয়োজনীয়তা মেটাচ্ছেন। সকাল ৯টা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামের সহজ-সরল সাধারণ মানুষদের মধ্যে নিরন্তর তথ্য প্রযুক্তির আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রের উদ্যোক্তারা। আর সেবা গ্রহীতাদের আগে ছোটখাট কোনো কাজের জন্যে স্থানীয় উপজেলায় বা জেলা শহরে যেতে হলেও এখন নিজ ইউনিয়নে বসে তার সব কাজ সেরে নিচ্ছেন সাশ্রয়ী খরচে। সময় এবং অর্থ দুইই বাঁচছে।

ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টার সম্পর্কে জানা গেছে, এখানে ভূমি সংক্রান্ত সকল প্রকার নথির নকল প্রাপ্তির আবেদন, নতুন-পুরাতন বিদ্যুত্ বিল প্রদান, বিদ্যুত্ সংযোগ বা বৈদ্যুতিক মিটারের আবেদন, মোবাইল ব্যাংকিং, কম্পিউটার কম্পোজ, ফটোকপি, লেমিনেটিং, ফ্লেক্সিলোড, কৃষি তথ্য সেবা, জন্ম নিবন্ধন বা মৃত্যু সনদ, ই-মেইল, ইন্টারনেট, অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আবেদন পূরণ কিংবা চাকরির আবেদন, সরকারি-বেসরকারি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক যে কোনো প্রতিষ্ঠানের খবরা-খবর সংগ্রহ, পাসপোর্টের ফরম পূরণ, বিদেশ যাওয়ার জন্যে নিবন্ধন, বিদেশের ভিসা আবেদন এবং ভিসা যাচাই, ছবি তোলা, ভিডিও কল করা, স্ক্যান করা, যাবতীয় ছাপার প্রিন্টিংয়ের কাজ ও বিভিন্ন ডিজাইনের কাজসহ যাবতীয় কাজ করা যায়। পাশাপাশি তরুণদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণও দেয়া হয় এই ডিজিটাল সেন্টারে। প্রশিক্ষণ শেষে দেয়া হয় সনদ। যে সনদ সরকারি বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে গ্রাহণযোগ্য।

যে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার গ্রামীণ জনপদে আলো ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত সেই প্রতিষ্ঠান নিয়ে সম্প্রতি (গত ১১ নভেম্বর ২০১৪) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করার লক্ষ্যেই ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। নিজের পায়ে দাঁড়ানো শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আমরা আমাদের বেকার যুবকদের জন্য এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো যাতে তারা বিদেশে গিয়েও কর্মসংস্থান করতে পারে।’

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের ‘ডিজিটাল সন’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘ডিজিটাল সেন্টারের এ সকল উদ্যোক্তাদের উচ্ছেদ করার কিছু হীন চক্রান্ত চলছে। এ চক্রান্ত সফল হবে না। ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের সরানো হবে না। তারা তাদের নিজ নিজ স্থানে বহাল থাকবে।’

প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যের পরে ডিজিটাল সেন্টারে কর্মরতদের মাঝে নিশ্চয়ই গতিশীলতা এসেছে। যে সব ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছিলো সেগুলোও মিটে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। যুবসমাজের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর এ অবস্থানের প্রশংসা করতে হয়। তবে এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট শক্তিশালী নীতিমালা অনুসরণের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। ব্রডব্যান্ড লাইন না থাকার ফলে উদ্যোক্তাদের মডেম দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এর ফলে কাজের ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। আমার মনে হয়, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারকে অধিকতর কার্যকর করতে যত দ্রুত ব্রডব্যান্ড লাইন দেয়া যাবে ততই মঙ্গল। সেই সঙ্গে উদ্যোক্তাদের বিষয়টিও ভাবতে হবে। সরকারের যে স্বপ্ন উদ্যোক্তারা পারঙ্গমতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করছেন তাদেরকে নিয়মিত উত্সাহ দিলে সেটা আরো গতিশীল হবে। তার লাভ কিন্তু সরকারের ঘরেই যাবে।

যে উদ্যোক্তারা তৃণমূল মানুষের দোরগোড়ায় তথ্যসেবা পৌঁছে দিতে দিন রাত্রি পরিশ্রম করছেন তাদের ভাগ্যোন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্যোগ ও পদক্ষেপ কার্যকর ভূমিকা রাখবে। আশা করি প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবের কারণে সব ধরনের জটিলতা থেকে মুক্তি পাবেন উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে উদ্যোক্তাদেরও আরও সচেতন হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তাদের ওপর ভরসা করে প্রযুক্তির যে বিপ্লব বাংলাদেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে দিতে চাইছেন তা বাস্তবায়নে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিতে হবে উদ্যোক্তাদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ‘ডিজিটাল সন’দের উন্নয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন এমনটিই আশা করছেন ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তারা।

n লেখক :প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, উত্তরা ইউনিভার্সিটি