আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় তিনটি দল জড়িত। দলগুলো হচ্ছে- শিক্ষক, ছাত্র ও সমাজ।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষা দুইভাবে পরিচালিত হচ্ছে। যথা- মুখোমুখি শিক্ষা ও দূরশিক্ষা। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকাই অনন্য। তবে শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে অগ্রসর শিক্ষার্থীরাও শিক্ষাদানের কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ যে বা যারা শিক্ষা গ্রহণ করছে তারা জড়বস্তু নয়। তাদের আছে মন-মনন, অভিরুচি, ভাবাবেগ ইত্যাদি। তাই শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সমমনা সহপাঠীদের অবদান কাজে লাগানো যেতে পারে। অর্থাৎ শ্রেণির অগ্রসর ছেলেটি অনগ্রসর ছেলের শিক্ষায় অবদান রাখতে পারে। তা ছাড়া শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্ররা সব সময় একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কিন্তু অগ্রসর ছেলেটির সঙ্গে অনগ্রসর ছেলেটি অনেকাংশেই একাত্ম। এ ধারণা থেকেই অগ্রসর ছেলে অনগ্রসর ছেলের শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর ফলে অগ্রসর ছেলেটিও লাভবান হয়। কারণ এ কাজের ফলে তার আত্মবিশ্বাসসহ অন্যান্য গুণের বিকাশ হয়।

প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে শিক্ষাদান হতো গুরুগৃহে। জীবন-জীবিকা জটিলতার রূপ পরিগ্রহ করার ফলে স্কুলের উদ্ভব ঘটে। আমাদের দেশে এখনো বয়সের চেয়ে মেধার ভিত্তিতে শ্রেণি গঠিত হয়ে থাকে। প্রতিটি শ্রেণিতেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মেধার তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। তাই অগ্রসর ছেলের পাশাপাশি একই শ্রেণিতে অনগ্রসর ছেলেও থাকে। অনগ্রসর ছেলের শিক্ষাকাজে অগ্রসর ছেলের ব্যবহার দীর্ঘদিন থেকে এ দেশে চালু আছে। এ ব্যবস্থাকে মনিটোরিয়াল শিক্ষাদান ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে। মনিটোরিয়াল সিস্টেমের পাশাপাশি বর্তমানে সতীর্থ শিক্ষণ পদ্ধতিও (Peer Teaching) চালু আছে। বলা যায়, এটি মনিটোরিয়াল সিস্টেমের আধুনিক সংস্করণ।

বাংলাদেশের বৃহৎ শিক্ষাব্যবস্থায় উপযুক্ত শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন থেকে অনুভূত হচ্ছে। শিক্ষকতা পেশায় উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবও শাশ্বত। ফলে অগ্রসর শিক্ষার্থীকে শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষকের পাশাপাশি কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা এখনো বেশ সম্ভাবনাময়। এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা উচ্চ মেধাবী, দূরদর্শী ও কর্মঠ তারা ক্লাস পরিচালনায় শিক্ষকের সহকারীর মতো কাজ করতে পারে। আর যারা সাবেক শিক্ষার্থী তারাও তাদের অবসরে ক্লাস নিতে পারে, অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারে, সফলতার কাহিনী শুনিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দীপিত করতে পারে, জীবনযুদ্ধের কাহিনী শুনিয়ে শিক্ষার্থীদের সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী করতে পারে, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন এবং দেশ ও সমাজের প্রতি কতর্ব্যবোধে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে পারে।

বর্তমানে শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতিতে এসেছে নানা পরিবর্তন। আইসিটিনির্ভর শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহৃত হচ্ছে শ্রেণিকক্ষে। কারিকুলাম প্রণীত হচ্ছে শিক্ষার্থীর চাহিদা, প্রয়োজনীয়তা ও অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। শিক্ষার বিষয়বস্তু প্রণয়নে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। শিক্ষকদের ডিজিটাল কনটেন্ট প্রস্তুতির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ হচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অসমতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে প্রশিক্ষণ পরিচালনায় প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন প্রশিক্ষণার্থীদের সাহায্য নিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যারা একেবারেই নতুন তাদের অভিজ্ঞ প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে জুটি বেঁধে দেওয়া হয়। ফলাফলে দেখা গেছে, অগ্রসর সহপাঠীর সহযোগিতায় ও প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বেশ সফলতার স্বাক্ষর রেখেই প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের দিয়ে ক্লাস পরিচালনাসহ শিখন-শেখানোর বর্তমান ধারা আরো সক্রিয়ভাবে কাজে লাগানোর যৌক্তিকতাকে মেনে নিয়ে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরতে চাই। পরিকল্পনাটি হচ্ছে- বিদ্যালয়ভিত্তিক ‘শিক্ষার্থী রিসোর্স টিম’ গঠন করা। এ টিমের অন্তর্ভুক্ত হবে এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ের বিভিন্ন বিভাগের সেরা শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি বিদ্যালয় তাদের শিক্ষার্থীদের মনোনয়ন দেবে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট না হওয়া পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ক্লাসে তারা শিক্ষাদান করে যাবে। এটিই হবে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অনুশীলন, যা ভবিষ্যতে তারা কর্মজীবনেও কাজে লাগাতে পারবে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে শিক্ষক প্রতিভা চিহ্নিত করার কোনো প্রয়াস আজও পরিলক্ষিত হয়নি। দেশে যা চালু আছে তা হলো ঠেকে শিক্ষকতায় আসা, আত্মবিশ্বাসে দুর্বল ও পেশার প্রতি নিরাসক্ত একটি বিশাল গোষ্ঠীকে দায়সারা প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষক হিসেবে তৈরি করে জাতি গঠনের ভার চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি। এ কথা মনে রাখতে হবে যে বর্তমানে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রতিশ্রুতিশীল। তবে যে বিষয়ের অভাব আছে তা হলো মূল্যবোধ। নম্বরমুখী মূল্যায়নব্যবস্থার চাপে শিক্ষার্থীরা তাদের ভেতরের প্রতিভাকে আবিষ্কার করার সুযোগই পায় না, অনুশীলন তো দূরের কথা। তাই শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানো কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে পারলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে এবং যা হবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য অনুকরণীয়। শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষককে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবসম্পন্ন হতে হবে। শিক্ষার্থীরা যদি মনে করে, শিক্ষক তাঁর নিজের শ্রম ও কাজের চাপ কমানোর জন্য কোনো শিক্ষার্থীকে ব্যবহার করছেন, তাহলে তা সফল হবে না। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের সচেতনতা ও সমর্থন দরকার হবে। এগিয়ে আসতে হবে গণমাধ্যমকেও। তবেই সতীর্থবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থার সুফল পাবে বাংলাদেশ।

লেখক : উপ-উপাচার্য, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়।