এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। দুটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠলে এটাকে আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বলতে পারি। দীর্ঘস্থায়ী এবং সুদৃঢ় সম্পর্ক দুটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। বাণিজ্য, সুশাসন, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশ সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারও সাথে বৈরিতা নয় এই নীতি অনুসরণ করে বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। বন্ধু রাষ্ট্রের তালিকা দিন দিন আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে। বর্তমান সরকার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গঠনে বন্ধুপ্রতিম উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশসমূহের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। সমসাময়িক সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর অত্যন্ত সফল ও তাত্পর্যপূর্ণ।  বিশ্লেষকদের মতে, চলমান সম্পর্কের উন্নয়ন বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে অর্থনীতির উন্নয়ন, পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতার কথা।

রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আমাদের স্মরণ করতে হবে জাপানকে। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশ এবং জাপান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। জাপান আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জাপানের অবদান অনন্য উচ্চতায়। সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জাপান সরকার প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা এবং  টেকনিক্যাল অ্যাসিসটেন্স দিয়ে আসছে। দেশটির সরকার বাংলাদেশকে ৫টি প্রকল্পে মোট প্রায় ১.২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেবে যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। উক্ত ঋণ সহায়তা নামমাত্র সুদে (০.০১ শতাংশ) ৪০ বছর সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ, প্রাকৃতিক গ্যাসের যথাযথ ব্যবহার, স্থানীয় সরকার উন্নয়নে অবকাঠামো নির্মাণ, হাওর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জীবনমান উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের কৃষি উত্পাদনশীলতা উন্নয়নে এই ঋণ সহায়তা প্রদান করা হবে। রাজধানীতে মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্পেও এগিয়ে এসেছে জাপান। উত্তরা থেকে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। যার ১৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকাই আসবে বৈদেশিক সহায়তা থেকে। বাকি ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আসবে সরকারি অর্থায়নে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে ৪০ কোটি ডলার দেয়ার কথা বলেছিল জাপান, দেশটি এখন সেই অর্থের পুরোটাই মেট্রোরেল প্রকল্পে দেবে। উষ্ণ সম্পর্ক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক জাপান বাংলাদেশ সম্পর্ক তার বড় উদাহরণ। আর এখানেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কূটনৈতিক সফলতা।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন বর্তমানে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরাশক্তি। বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যকার সম্পর্ক বহু পুরাতন এবং বলিষ্ঠ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই চীন আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকায়নে এবং নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্পে সহযোগিতা করে আসছে। নব্বই পরবর্তী চীনা অর্থনীতির উন্নয়ন এই সম্পর্কের মাত্রা আরও বেগবান করেছে। বাণিজ্যের প্রসার, সহজ ঋণ, সামাজিক যোগাযোগ, সংস্কৃতি বিনিময়, শিক্ষা সম্পৃক্ততা, অবকাঠামো উন্নয়ন, সামরিক সহযোগিতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে ঢাকা-বেইজিংয়ের মধ্যে কার্যকরী যোগাযোগ রেখে চলছে বর্তমান সরকার। উল্লম্ফন অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং শ্রমের মূল্য অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় চীনের শ্রমঘন উত্পাদন ব্যবস্থা পুঁজিঘন উত্পাদন ব্যবস্থার দিকে প্রভাবিত হচ্ছে। শিল্প বিনিয়োগে বেইজিংয়ের আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাজারের বর্তমান অবস্থা ধরে রাখার জন্য চীনা বিনিয়োগকারীরা দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝখানে বাংলাদেশের সহজলভ্য শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে চাচ্ছে যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুযোগ। অন্যান্য সরকারের তুলনায় বর্তমান সরকারের সাথে চীনের সম্পর্ক উল্লেখ করার মত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের আগেই দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ দেয়া হয় চীনা প্রতিষ্ঠান ‘চায়না মেজর ব্রিজ’কে। বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে চীন বাংলাদেশ সরাসরি গার্মেন্টশিল্পে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। বেইজিংয়ে ৯ জুন ৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়, যার অন্যতম বরগুনার রামনাবাদে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন। চীনের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা। প্রধানমন্ত্রীর সফরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে আলোচনায় অগ্রগতি হয়। আরও দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়, যার একটি হলো চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেনভিত্তিক টানেল নির্মাণ। চীন এ প্রকল্পে সহজ শর্তে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে। দেশে টানেল বা এ ধরনের সুড়ঙ্গপথ হবে —এটাই প্রথম। চীনের একটি প্রতিষ্ঠান এটি নির্মাণ করবে। অর্থনৈতিক-কারিগরি সহযোগিতা, দুর্যোগে উদ্ধারকাজে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও বন্যা প্রতিরোধ-ব্যবস্থাপনার জন্য সমীক্ষায় চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশই বেশি লাভবান হবে। চট্টগ্রামে চীনের অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলে বিনিয়োগে চীনা উদ্যোক্তারা আগ্রহী হবেন। দারিদ্র্য দূরীকরণে চীন সরকার শর্তহীনভাবে সুপার হাইব্রিড ধানের বীজ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ধানের ফলন এতে বেড়ে প্রায় দেড়গুণ হবে। চীন বাংলাদেশে হাইব্রিড রাইস ল্যাবরেটরি স্থাপনেও আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। সন্ত্রাসবাদ দমন, সীমান্ত সমস্যার সমাধান, তিস্তার পানি বণ্টন, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো ও আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন বেশ তাত্পর্যপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের রাষ্ট্রীয় সফর বাংলাদেশের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ সেখানে বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দেয়া হয়েছে। গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যেখানে আছে, সেখান থেকেই নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায়। তিনি দারিদ্র্য দূরীকরণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সন্ত্রাস, চরমপন্থা ও মৌলবাদ মোকাবিলায় ভারত-বাংলাদেশের সহযোগিতা আরও দৃঢ়করণের কথা বলেন। সার্কভুক্ত দেশগুলোর উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারত দাতারাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্র, যেমন আইটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও ক্ষুদ্র উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য ভারতের আগ্রহ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে দুই  দেশের উষ্ণ সম্পর্ক বলবত্ থাকলে মিউচুয়াল বেনিফিট পাওয়া যাবে। উদাহরণস্বরূপ, প্রথমবারের মত ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ সংযুক্ত গ্রিডের মাধ্যমে বাংলাদেশে রপ্তানি হচ্ছে যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। একইভাবে রেলওয়ে ডেভেলপমেন্ট, গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদন উন্নয়নে ভারতের আগ্রহ বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। বাংলাদেশ ও ভারতের দীর্ঘদিন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মূলভিত্তি আস্থা, সদ্ভাব ও অংশীদারিত্ব। দুই দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সাম্য, সমতা, স্থিতিশীলতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে তা এগিয়ে নেয়া দুই দেশেরই লক্ষ্য আর এলক্ষ্যে বর্তমান সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। উষ্ণ ও কার্যকরী সম্পর্ক বজায় থাকলে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। এছাড়া দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় ইস্যু ও চ্যালেঞ্জগুলোকে সামনে রেখে এবং সামষ্টিক মনোভাব নিয়ে সম্পর্ক শক্তিশালী করলে দুই দেশেরই উপকার হবে। এছাড়া পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস এবং সচেতনতা তৈরি এবং ব্যাপকভিত্তিক তথ্য বিনিময়ের জন্য দুই দেশের শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী, গণমাধ্যম কর্মী, পরিবেশবিদ, করপোরেট ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন পেশার নাগরিকদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিরও প্রয়োজন রয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে অধিকতর ভালো। এ সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া অন্যতম। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময় থেকেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছিলেন। ঠিক তার ৪ দশক পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ১৪ থেকে ১৬ জানুয়ারি ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে রাশিয়া যান। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের কোনো সরকার প্রধানের রাশিয়ায় এটি দ্বিতীয় সফর। নানা কারণে এ সফর রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। সফরে ২ হাজার মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র, ১০০ কোটি ডলারের সমরাস্ত্র কেনাসহ ৩টি চুক্তি ও ৬টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে ঐতিহাসিক সম্পর্ক। বিশ্লেষকদের মতে প্রধানমন্ত্রীর সফরে সেই সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে সাহায্যের জন্য ’৭১-এর ৬ ও ১৩ ডিসেম্বর নিউক্লিয়ার মিসাইলবাহী নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ পাঠায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া এভাবেই বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের অনবদ্য নজির দেখিয়েছিল। তখন থেকেই ২ দেশের সম্পর্কের শুরু। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় দেশটি; কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালে নৃশংস হত্যার পর এই সম্পর্কে চরম ভাটা পড়ে। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে সম্পর্ক আবারও নতুন ছন্দ পায়। তার আগেই অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গঠিত হয় আধুনিক রাশিয়া। ঢাকায় এর পর সমরাস্ত্রের একটি প্রদর্শনীও হয় ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে। ফলে চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গেও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাংলাদেশি পণ্যের একটা বড় বাজারে পরিণত হয় রাশিয়া। রাশিয়ায় যেসব পণ্য বাংলাদেশ রপ্তানি করে তার মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, হিমায়িত খাদ্য, কৃষি, চামড়াজাত পণ্য এবং ওষুধ। প্রধানমন্ত্রীর সফর রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পাশাপাশি বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত বড় বাজার সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সবচেয়ে আলোচিত ছিল অস্ত্র কেনা চুক্তি। নিন্দুকেরা যাই বলুক না কেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বিশাল সমুদ্র বিজয়ের পর তার সুরক্ষায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অত্যন্ত যৌক্তিক। তাছাড়া ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা সংক্রান্ত মামলার রায় বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে। সমুদ্রের এ বিশাল অংশে গ্যাসসহ নানা মূল্যবান  খনিজসম্পদ রয়েছে। এসব মাথায় রেখেই সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর জন্য ওই অস্ত্র ক্রয় চুক্তি করা হয়। রাশিয়া সফরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্রের জন্য অর্থনৈতিক, কারিগরি ও প্রযুক্তি সহায়তা। ৫ স্তরের নিরাপত্তা সম্বলিত তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২টি ইউনিটের সমন্বয়ে এ বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। প্রতিটি ইউনিটের জন্য খরচ হবে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ কোটি ডলার। বিদ্যুত্ কেন্দ্রের মেয়াদ হবে ৬০ বছর। রাশিয়া প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আমন্ত্রণে শেখ হাসিনার এ সফর ছিল দীর্ঘ ৪০ বছর পর বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার রাশিয়া সফর। তাই এটি কোনো সৌজন্য সফর ছিল না। সম্পর্কের গভীরতা ইঙ্গিত দেয় ২টি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর। প্রধানমন্ত্রী মস্কো সফরে সমরাস্ত্র কেনা ও পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে দেশি মুদ্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার এ ২ ঋণচুক্তি হয়েছে। সমরাস্ত্র কেনার চুক্তিটি ৮ হাজার কোটি টাকা, যা ঋণ হিসেবে দেবে রাশিয়া। এর সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণে দেবে আর ৪ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সন্ত্রাস দমনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

ক্ষুদ্র ভূখণ্ড কিন্তু বিশাল জনসংখ্যার এই বাংলাদেশের প্রয়োজন অত্যন্ত দক্ষ, সুচিন্তিত এবং উদ্ভাবনী বৈদেশিক নীতি যাতে করে অপরাপর রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে সর্বোচ্চ আর্থ-সামাজিক সুবিধা আদায় করা সম্ভব হয়। সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈদেশিক নীতির প্রতিফলন ঘটে বহুলাংশে যেখানে নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন প্রাধান্য পায়। নিরাপত্তা বলতে ভৌগোলিক নিরাপত্তাই নয় শুধু, ব্যক্তি, পরিবেশ, পানি, জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা বেশি প্রণিধানযোগ্য। উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝব এমন একটি পরিবেশ এবং ভৌত কাঠামো যেখানে বৈদেশিক ব্যবসা এবং বিনিয়োগের উপর জোর দেয়া হয় যেন জাতীয় বাজেট এবং সরকারি উন্নয়ন সহায়তা দারিদ্র্য বিমোচন-দূরীকরণ, অপুষ্টি, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবা, মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে ব্যবহূত হয়। জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ভিশন-২১ সামনে রেখে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে পারাটাই হবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য।

n লেখক :প্রো-ভিসি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি