অটিজম মোকাবিলায় বাংলাদেশ, দৈনিক জনকন্ঠ

অটিজম কোনো বংশগত বা মানসিক রোগ নয়, এটা স্নায়ুগত বা মানসিক সমস্যা। এ সমস্যাকে ইংরেজিতে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বলে। অটিজমকে সাধারণভাবে শিশুর মনোবিকাশগত জটিলতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অটিজমের লক্ষণগুলো একদম শৈশব থেকেই, সাধারণত তিন বছর থেকে প্রকাশ পেতে থাকে বলে চিকিত্সাবিজ্ঞান মনে করে। বাংলাদেশে একসময় অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের চরম আক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে। অটিজমকে পাপ বা অভিশাপ হিসেবে অ্যাখ্যা দেওয়া হতো। ভাবা হতো, অটিস্টিক শিশুরা সমাজের বোঝা। পরিবারের কাছেও তারা ছিল অবহেলিত। পরিবারের সদস্যরা অটিস্টিক শিশুদের সমাজ থেকে লুকিয়ে বা মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতো। কিছুদিন আগেও অটিস্টিক শিশুদের সুষ্ঠু স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্যে ছিল না যথাযথ পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা। এই শিশুদের জন্য বর্তমান সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা বিরল। অটিস্টিক শিশুদের বিকাশের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার দক্ষ-অভিজ্ঞ প্রশিক্ষিতদের মাধ্যমে অটিস্টিকদের তত্ত্বাবধান, বিশেষ শিক্ষা কর্মসূচির ব্যবস্থা, প্রত্যেক শিশুর বিশেষ চাহিদা পূরণ, বিকলাঙ্গ শিশুদের আর্থিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং মানসিক ও শারীরিক উভয় ধরনের অটিস্টিক শিশুদের উত্সাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করার কাজটি গুরুত্ব দিয়ে করছে।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৯ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয় যা পরে জেপিইউএফ-এ পরিণত হয়। অটিজমসহ এনডিডি (নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার) আক্রান্তদের চিকিত্সাসহ যাবতীয় অধিকারের সুরক্ষা আইনের আওতায় আনতে ২০১৩ সালে ‘ডিজএবিলিটি ওয়েলফেয়ার অ্যাক্ট’ ও ‘দ্য ন্যাশনাল নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার প্রটেকশন ট্রাস্ট অ্যাক্ট’ করা হয়। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিনামূল্যে থেরাপিউটিক, কাউন্সিলিং ও অন্যান্য সেবা এবং সহায়ক উপকরণ দেওয়া হয়েছে।

দেশের ৬৪টি জেলা ও ৩৯টি উপজেলায় মোট ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার চালু করা হয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে ২৪ লাখ প্রতিবন্ধী সেবা গ্রহণ করছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ ১৫টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করে অটিজম ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল সমস্যাজনিত শিশুদের চিকিত্সা প্রদান করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে অটিজম আক্রান্তদের শনাক্ত করে তাদের কাউন্সিলিং ও চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম’-এর মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইসিডিডিআরবির মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুদের প্রাথমিক পরিচর্যাকারী হিসেবে মায়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া অটিজম ও স্নায়ু-বিকাশজনিত সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করার জন্যে বিশেষজ্ঞ গ্রুপের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের উপযোগী করে স্ক্রিনিং টুলস প্রণয়ন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

অটিজম আক্রান্তদের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষায় নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন ও সেখানে তিন হাজার একশ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকার পরিবর্তন হলেও সেবামূলক এই কার্যক্রম যেন ব্যাহত না হয়, সে বিষয়টি মাথায় রেখেই শেখ হাসিনা এই ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বিশেষ সফটওয়্যার’ তৈরি করে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধীদের কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন। এ ছাড়াও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন প্রত্যেক শিশুকে শিগগিরই ‘প্রিভিলেজ কার্ড’ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চিকিত্সা, কেনাকাটা, শিক্ষা, গাড়ি পার্কিংসহ সবক্ষেত্রে তারা বিশেষ সুবিধা পাবেন। এসব পদক্ষেপ থেকে এটা স্পষ্টভাবেই বলা যায়, প্রতিবন্ধীদের প্রতিপালনে রাষ্ট্রের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করছে সরকার। আর অব্যাহতভাবে এই কার্যক্রম পালন করা এবং এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ কল্যাণকর রাষ্ট্রের অন্যতম স্থানে রয়েছে, যা প্রতিটি বাঙালির গর্ব।

লেখক:উপ-উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি