আমাদের তরুণ সমাজ দেশের জন্য সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত্। কিন্তু বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম ভয়াবহ রকমের মাদক ঝুঁকিতে রয়েছে। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতার কারণে সহজেই তাদের হাতে মাদকদ্রব্য চলে আসছে। কৌতূহলবশত বা অসত্ সঙ্গে পড়ে বা হিরোইজম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা মাদক গ্রহণ করছে। এভাবে ধীরে ধীরে মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে নিজেদের জীবনকে ভয়ানক হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ প্রবণতা রোধ করা না গেলে একটি প্রজন্মের সব সম্ভাবনা ধূলিসাত্ হয়ে যাবে এবং দেশ মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি হারিয়ে ফেলবে। তাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

মাদকাসক্তির ফলে বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। শারীরিক সমস্যার মধ্যে খাদ্যে অরুচি, পুষ্টিহীনতা,শরীরের বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণ, যকৃত, অন্ত্র, কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গে ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টি হয় যার শেষ পরিণতি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। মানসিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হওয়া। মাদকাসক্তির ফলে ব্যক্তি তার স্বাভাবিক আচরণ হারিয়ে ফেলে। স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, ধৈর্যচ্যুতি ইত্যাদি নেতিবাচক আচরণ ব্যক্তির মধ্যে প্রকট হয়ে উঠে যা ক্রমাগত তাকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে। সামাজিক সমস্যার মধ্যে চুরি, ছিনতাই, সামাজিক সহিংসতা, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি অন্যতম। মাদকাসক্তি কোনো দিক থেকেই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনতে পারে না, বরং সমাজকে গভীর অন্ধকারের দিকে ধাবিত করে।

মাদকের ভয়াবহতা থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত যথাযথ আইন থাকা জরুরি। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন তৈরি হয়। পরবর্তীকালে এ আইনের সংস্কার হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার মাদকের ওপর জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর মাদক নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়েছেন। তাই আশা করা যায় মাদক নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে গাফিলতি আছে তা পুরো মাত্রায় দূর না হলেও অনেকাংশে স্তিমিত হবে। মাদকাসক্তদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী আহবান জানিয়েছেন এবং তাদের পুনর্বাসনে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু যারা এ আহবানে সাড়া দিবে না তাদের প্রতি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। মাননীয় প্রধামন্ত্রীর এই তদারকি এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে বলে আশা করা যায়।

মাদকাসক্তি একটি রোগ। তাই এ রোগ নিরাময়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা, পরিমিত জীবন-যাপন, বন্ধু নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে পরিবার সচেতন হলে সন্তানকে এই ভয়াবহ আসক্তি থেকে দূরে রাখা সম্ভব। তাই সন্তান কোনো অস্বাভাবিক জীবন-যাপন করছে কী না, কেমন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিশছে ইত্যাদি বিষয়ে পরিবারের নজর রাখতে হবে। তাছাড়া পরিবারের কেউ মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকে গেলে তাকে মাদকের খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে বোঝাতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিত্সার ব্যবস্থা করতে হবে। ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখাও মাদক থেকে তাদের দূরে রাখার একটি উপায় হতে পারে। তাদের এটিও বোঝাতে হবে মাদক থেকে দূরে থাকার জন্যে ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট এবং এক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। মাদকের ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মাদকের সহজলভ্যতা রোধ করতে হবে। মাদকাসক্তদের সুস্থ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।

সমাজে মাদকের প্রাপ্যতা নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব। তাই সমাজে বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মাদকের চাহিদা ও ব্যবহার কমিয়ে আনা জরুরি যা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। বেকারত্ব, কর্মসংস্থান ও সুস্থ বিনোদনের অভাব মাদক ব্যবহারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এজন্যে তরুণদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সুস্থ বিনোদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মাদক চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে সীমান্তে ও দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো তত্পর হতে হবে। মাদকের চিকিত্সা দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল হওয়ায় প্রতিরোধই উত্কৃষ্ট পন্থা। এজন্য প্রয়োজন ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রয়াস। যুবসমাজ আমাদের দেশের সম্পদ। তাই কোনো পক্ষের গাফিলতির কারণে এদের জীবন যাতে ঝুঁকিপূর্ণ পথে পরিচালিত না হয় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আমরা যদি সকলে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে একযোগে মাদককে ‘না’ বলি তবে একত্রিত ‘না’ এর শক্তি আমাদের যুবসমাজকে রক্ষা করবে।

লেখক :প্রো-ভিসি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি