বিশ্বের ৬শ’ ৫৪ কোটি মানুষের অর্ধেকের বেশি নারী। বাংলাদেশের চিত্রও অভিন্ন। ১৬ কোটি মানুষের মাঝে নারীর সংখ্যা অর্ধেক। এ অবস্থায় নারীর ক্ষমতায়ন ও তার সক্ষমতা প্রমাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু সম্প্রতি মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে সরকারের নানা অংশ থেকে যে আলোচনা হচ্ছে তা বিবেকবান ও সচেতন মানুষের মাঝে শঙ্কা সৃষ্টি করছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নসহ বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মাননীয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় আসার পর একে একে পূরণ হতে থাকে সব প্রতিশ্রুতি। শুরুতেই তিনি বিশ্ববাসীকে চমকে দেন পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও কৃষির মত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল তিনটি পদে নারী নেতাদের দায়িত্ব দিয়ে। এর কিছুদিন পর জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী স্পিকার নির্বাচিত হন। দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে আসেন নারীরা। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি, বিচারপতি ও পুলিশ সুপার পদেও নারী তার যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেলেন। সশস্ত্র বাহিনীর কমিশন্ড র্যাঙ্কেও চলে নারী সদস্যের অন্তর্ভুক্তি। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাতে যে কর্মযজ্ঞ চলছে তার সুফল ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি তারই প্রমাণ। গড় আয়ু বৃদ্ধির অন্যতম কারণ শিশু ও প্রসূতি মৃত্যুর হার কমা।
বাল্যবিয়ের কথা আসলেই মৌসুমী ভৌমিকের গানের কথাগুলো খুব মনে পড়ে। “তোরি জন্য শরীরের ভারে আমি নত, তোরি জন্য গল্প বুনেছি কত কত … তোরি জন্য গান, তোকে ঘিরেই খেলা, তোকেই দিচ্ছি আমার সকাল ছেলেবেলা …… ”
জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক তহবিল, ইউএনএফপি-এর গবেষণা মতে, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোর ১০-১৭ বছর বয়সী আট কোটি ২০ লাখ কন্যাশিশুর বিয়ে হয় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে। এরা মানসিক, শারীরিক ও যৌনজীবনে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ৫৫ শতাংশ কন্যা শিশু মাধ্যমিকে ঝরে পড়ে বিয়ের পর স্বামীর সংসারে কায়িক শ্রম দেয়ার কারণে।’ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এর যৌথ জরিপ ‘প্রগতির পথে’র তথ্য মতে, ‘উত্তরাঞ্চলের চরাঞ্চল এবং বরেন্দ্র এলাকায় ২০-৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৭৪ শতাংশেরই ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে।’ বিশ্বের যে কয়টি দেশে বাল্যবিয়ের হার বেশি, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সরকার অবৈতনিক শিক্ষা, উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও কমছে না এ প্রবণতা। এমনকি আইন করে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ বলা হলেও বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের ৫ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে। এর মধ্যে শতকরা ২৯ ভাগ মেয়েরই বিয়ে হয় ১৫ বছরের কম বয়সে আর শতকরা দুই ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১১ বছরের কম বয়সে অর্থাত্ ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সের দুই-তৃতীয়াংশ কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হয়।’ সেভ দ্য চিলড্রেন-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।’ প্রতিবেদন দুটিতে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত নারীদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে ধরা হয়েছে তাই বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ব্র্যাকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ‘বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার ৬৫ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ এবং পৃথিবীতে চতুর্থ। এ ক্ষেত্রে নাইজার, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও চাঁদ-এর পরই বাংলাদেশের অবস্থান।’
বিয়ের বিদ্যমান বয়স কমানোর চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এ ক্ষেত্রে ছেলেদের বয়স ১৮ এবং মেয়েদের ১৬ করা যায় কিনা, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এখন বয়স কমিয়ে যদি ১৬ বছর করা হয় তাহলে এই পরিসংখ্যান পাল্টে যাবে। বাল্যবিয়েপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থার হয়তো উন্নতি ঘটবে কাগজে-কলমে এতে লাভ কি হবে? বরং বাস্তবে আরো জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। সরকারের দিন বদলের অঙ্গীকারে রয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫৪ থেকে কমিয়ে ১৫ করা হবে এবং ২০২১ সালের মধ্যে মাতৃ মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩৮ থেকে কমিয়ে ১৫ করা হবে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা না গেলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। যেখানে ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে পুরোপুুুরি বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে সেখানে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে ১৬-তে নামিয়ে আনার ভুল পদক্ষেপ জাতিকে আবার পেছনে ঠেলে দিবে। কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের প্রথম শিকার হয় শিশু, দ্বিতীয় শিকার নারী এবং তৃতীয় শিকার সমাজ। এর সুদূরপ্রসারী ফল প্রকারান্তরে সমগ্র জাতির ওপর এসে পড়ে। স্বামী, সংসার, শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে বুঝে ওঠার আগেই সংসার এবং পরিবারের ভারে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ি থেকেও তার ওপর চাপের সৃষ্টি হয়, শুরু হয় অশান্তি, পারিবারিক কলহ, নির্যাতন। এই নির্যাতনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হয় পরিবারের সবাই, বিশেষ করে শিশুরা ভোগে নানা মানসিক অশান্তিতে। এতে তারা লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়, পরিবারের প্রতি জন্মে নানারকম অনীহা, ফলে তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নানারকম অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। বাল্যবিয়ের শিকার ছেলে ও মেয়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনের মত মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, যা তাকে তার সারাজীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে। অপরিণত বাড়ন্ত পুষ্টিহীন শরীরে বেড়ে উঠে আরেকটি অনাগত ভবিষ্যত্ অপুষ্টিগত অভিশাপের বোঝা নিয়ে। জন্ম দিবে কিছুদিন পর আরেকটি অপুষ্টিতে আক্রান্ত প্রজন্ম। বেড়ে চলে মা ও নবাগত শিশুর জীবনের ঝুঁকি।
তাই নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য সঠিক বয়সকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণায় দেখা যায়, বাবারা যখন সচেতন হচ্ছেন তখন বাল্যবিয়ে ঠেকানো আরও সহজ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে আরও বেশি বরাদ্দ দেওয়া উচিত। মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখা, বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েদের সহায়তা করা, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে লড়াই ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য পাওয়ার ব্যাপারে সরকারের আরও অনেক সচেতন হওয়া উচিত। রেডিও, টেলিভিশনে ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে জনগণকে আরও সচেতন করতে হবে। জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যতীত কোনো ভাবেই নিকাহ্ রেজিস্ট্রার যেন বিয়ে নিবন্ধন না করেন, এ ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। প্রতিটি ইউনিয়নে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। পাঠ্যবইতে এ বাল্যবিয়ের কুফল অন্তর্ভুক্ত করা হলে এর সুফল পাওয়া যাবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে নারী সংগঠন, বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সরকারের সমন্বিত সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকতে হবে। প্রেস কনফারেন্স, মানববন্ধন ও গ্রাম পর্যায়ে উঠান বৈঠক ও মা সমাবেশ এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হবে। এছাড়া নারীর সঠিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে বেড়ে ওঠা এবং পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরকারের বাল্যবিয়ের আইনটির যথাযথ প্রয়োগ এবং প্রয়োজনবোধে এই আইনের সংস্কার করে এক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ ও অর্থদণ্ড বাড়ানো যেতে পারে।
তাই বাল্যবিয়ে বন্ধে অবশ্যই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এখন থেকেই আমরা চাই বাল্যবিয়ের কারণে মেয়েদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি, শিক্ষা না পাওয়া, যৌতুকের বলি হওয়া এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলে আর আবদ্ধ না হোক। জীবনকে উপভোগ করুক নির্মল আনন্দে। নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানতম বাধা হিসেবেও বাল্যবিয়ে চিহ্নিত করা যায়। বাল্যবিয়ের শিকার ছেলে বা মেয়ে সে যাই হোক না কেন সে তার উচ্চ শিক্ষা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুশিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হয়। ফলে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শিশু, কিশোরী এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিশোররাও উন্নত জীবন ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। তাই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের উঁচুস্তর থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের; বিশেষ করে আমাদের রাষ্ট্র এবং প্রশাসনকে এ ব্যাপারে সবার আগে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে যেখানে শিশুর বয়সসীমা ১৮ বছর নির্ধারিত আছে, সেখানে ১৮ বছরের একটি ছেলে কিংবা ১৬ বছরের একটি মেয়ের বিয়ে আইনের চোখে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে? বিশেষ করে বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের বয়স ১৬ এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে বয়স ১৮ করার বিষয়টি কতটুকু যৌক্তিক তা আরও ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করি।