ড. ইয়াসমিন আরা লেখা শিক্ষাবিদ, ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিত। তিনি একাধিক গ্রন্থের সম্পাদক ও লেখক। তাঁর উত্সাহ ও ঔত্সুক্যের বিষয় বিচিত্র। তিনি শিক্ষা, শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন; আবার জাতীয় পত্রিকায় সমকালীন বিষয় নিয়ে কলাম লিখে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। পাঠের বৈচিত্র্য ও লেখনীর সাবলীলতায় তাঁর প্রকাশ দক্ষতা অনন্য। বাংলাদেশের সাহিত্যের সামগ্রিক, যুক্তিগ্রাহ্য ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করেছেন তিনি। শিল্প-সাহিত্যের আনন্দ ও সৌন্দর্যকে সম্যক অনুধাবন করার ক্ষমতা তাঁর আছে।
মূল্যায়নে তিনি লেখকের প্রতি নির্মোহ কিন্তু সহানুভূতিশীল। বিশ্লেষণ নৈপুণ্য, নিষ্ঠা, যৌক্তিক বয়ানে তিনি সতর্ক। তিনি শিক্ষিত ও সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে কবি ও কথাসাহিত্যিকদের টেক্সট বিশ্লেষণ করেছেন—বাংলাদেশের কবিতার কবি (২০১৩), অন্তরঙ্গ অবলোকন (২০১৩), তিন শিল্পী : শিল্পের অনুচেতনা (২০১৪) গ্রন্থত্রয়ে। ‘অন্তরঙ্গ অবলোকন’-এ মহাদেব সাহা, সুফিয়া কামাল ও আলাউদ্দিন আল আজাদের উপন্যাস নিয়ে তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘বাংলাদেশের কবিতার কবি’ গ্রন্থে বেগম সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা ও শেখ হাফিজুর রহমান সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। ‘তিন শিল্পী : শিল্পের অনুচেতনা’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের উপন্যাসে আলাউদ্দিন আল আজাদ, বাংলাদেশের কবিতায় সৈয়দ শামসুল হক, বাংলাদেশের কবিতায় হুমায়ুন আজাদ শীর্ষক দীর্ঘ তিনটি প্রবন্ধ।

বেগম সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, শেখ হাফিজুর রহমান প্রমুখ কবির কাব্যগুলো পর্যালোচনা করেছেন ড. ইয়াসমিন আরা লেখা। কাব্যের বিষয় ও প্রকরণ, ভাষাশৈলী, গঠনরীতি, পটভূমিকা ও অবয়ব নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব কবি অভিনবত্ব প্রদর্শন করেছেন এবং আধুনিকতাকে করেছেন প্রতিষ্ঠিত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বপ্নময় বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিরোধান কবিদের সৃজনশীলতায় প্রচণ্ড অভিঘাত সৃষ্টি করে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং একাত্তরের যুদ্ধের তাণ্ডবলীলা ও দেশব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ কবিদের সংকটগ্রস্ত ও দুঃসাহসী করে তুলেছিল। এ জন্য ৪০ কিংবা ৫০ কিংবা ৬০-এর দশকে প্রথম আবির্ভূত এসব আধুনিক কবির (শেখ হাফিজুর রহমান বাদে) জগত্ অনেক বেশি জটিল, দ্বিধায়, যন্ত্রণায়, সংশয়ে বন্ধুর। ব্যক্তি ও বাইরের জগতের দ্বন্দ্বময় ঘাত-প্রতিঘাত এখানে কোনো শান্তি পারাবারে অবগাঢ় হয়ে নিষ্প্রসন্ন হয়ে যেতে পারেনি। প্রাত্যহিক এখানে প্রবল এবং তীব্র। একালের কবিতার উত্স একালের জীবন। কাজেই কবিতাকে জীবন্ত হতেই হবে স্থানীয় বাচন শিখে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দ শামসুল হককে স্বতন্ত্র ও শক্তিমান কবি হিসেবে চিহ্নিত করে ইয়াসমিন আরা লেখার মূল্যায়ন হচ্ছে—‘স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়া ও নিজস্ব প্রতীতিজাত অনুভব তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে স্বকীয় নির্মাণ ধারায়। চেতনার নিজস্বতা, অনুভবের গভীরতা সূক্ষ্মতা ও শিল্পের নন্দনতাত্ত্বিক বোধের স্বকীয়তায় তাঁর কবিতা বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ’

ড. ইয়াসমিন আরা লেখার ভাষা সহজ-সরল, বিষয় উপযোগী। নিছক পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি করেননি তিনি। প্রাসঙ্গিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে তিনি একজন কবি কিংবা কথাসাহিত্যিককে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর গ্রন্থগুলোর বহুল প্রচার কাম্য।