বাংলাদেশে শিশু নির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। শিশু নির্যাতনের কিছু ঘটনা জনসমক্ষে আসছে আবার অনেক ঘটনা অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে। গত ১৮ অক্টোবর দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার সিঙ্গিমারী জমিরহাট এলাকায় পাঁচ বছরের একটি শিশু মানুষরূপী দানব কর্তৃক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। সাইফুল নামের এক নরপশু পাঁচ বছরের অবুঝ নিষ্পাপ এই শিশুটিকে ধর্ষণ ও লোমহর্ষকভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এ শিশুটিকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয়েছে যা সভ্য সমাজের বাসিন্দাদের পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। শিশুটির প্রতি সান্ত্বনা জানানোর ভাষাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এমন ঘটনায় নির্বাক হয়ে আমরা শুধু অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

সংবাদপত্রের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ঐদিন বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে শিশুটি নিখোঁজ হয়। ঘটনার রাতেই থানায় জিডি করেন এবং পরদিন ভোরে শিশুটিকে বাড়ির পাশে হলুদের খেত থেকে রক্তাক্ত ও মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরপর প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল, পরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শিশুটিকে। ভর্তির পরপরই শিশুটির ফরেনসিক পরীক্ষা করা হলে দেখা যায় তার মাথা, গলা, হাত ও পায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে শিশুটির প্রজনন অঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। এছাড়া শরীরে কামড়ের দাগ ও উরুতে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। শিশু সার্জারি, নিউরো সার্জারি, গাইনিসহ কয়েকটি বিভাগের আওতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা জানা গেছে, শিশুটির ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গে সংক্রমণ দেখা গিয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন চিকিত্সকরা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রয়োজনে অস্ত্রোপাচার করা হতে পারে। শিশুটির চিকিত্সায় ৯ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। চিকিত্সকরা বলছেন, শিশুটি এখন মানুষ দেখলেই ভয়ে চিত্কার করে কেঁদে উঠছে। নির্মম নির্যাতনের শিকার শিশুটি শুধু শারীরিকভাবেই নয় মানসিকভাবেও বড় ধরনের আঘাত পেয়েছে। এসব ঘটনা প্রমাণে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আদালতে উপস্থাপন করতে না পারা এবং পর্যাপ্ত সাক্ষীর অভাব থাকার ফলে শেষ পর্যন্ত অনেক অপরাধী পার পেয়ে যায়। আবার কখনো কখনো তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান বা বিভাগের কোনো কোনো সদস্যের অবহেলা বা অপরাধীদের সঙ্গে সখ্যের কারণেও এ ধরনের মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, দিনাজপুরের শিশু ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্তদের বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রসিকিউশনকে নির্দেশনা দেওয়া হবে। তিনি এ ঘটনায় দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তির প্রত্যাশা করে বলেছেন, এর ফলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ করতে কেউ সাহস পাবে না। আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্য যথাযথ। এখন প্রয়োজন জরুরি আইনের যথাযথ প্রয়োগ।

প্রসঙ্গক্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য তুলে ধরছি পাঠকদের জন্য। ঘটনার অব্যবহিত পরে এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষায় পরিচালিত ‘চাইল্ড হেল্প লাইন (সিএইচএল)’ উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে প্রতিটি মানুষের ভেতরে মানবিক গুণাবলী জাগিয়ে তুলতে হবে। অপরের ক্ষতি করতে গেলে নিজের ক্ষতি হতে পারে সেই চিন্তা থেকে প্রতিটি মানুষের নিজের ভেতরের মানবিক গুণাবলীটা জাগিয়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে সবার মাঝে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে ভেতরের সুপ্রবৃত্তিগুলো জাগ্রত করা প্রয়োজন। তবে মানুষের ভেতরকার পশুত্বটা যেন জেগে না ওঠে সেদিকে সুদৃষ্টি রাখা অবশ্য কর্তব্য।’

প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে বিবেচনায় নিয়ে দেশের নাগরিক সমাজ যদি নিজেরা এবং পরিবারের সবাইকে সুপথে চলার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন তাহলে সমাজের পরিস্থিতি অবশ্যই পরিবর্তন হবে। আমরা সবাই যদি নিজেদের ভেতরকার মানবিক গুণাবলী লালনের পাশাপাশি সমাজের সকল স্তরে তা প্রবাহমান করার উদ্যোগ নেই তাহলে দেশের অনেক সমস্যাই মিটে যাবে। মানুষের ভেতরে যে পশুত্ব সেটা নির্মূলে সমাজের মানুষদেরই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু বর্তমানে আমরা নিজেদের নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছি যে, সমাজের সমস্যা-সংকটে আমরা দাঁড়াতে পারছি না। যার ফলে সামাজিক বন্ধন যেমন নড়বড়ে হচ্ছে তেমনি সমাজে নানা ধরনের অপরাধও বাড়ছে। এ থেকে মুক্ত হতে আমাদের সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারুণ্যের কবি সুকান্ত বলেছিলেন— ‘চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব  জঞ্জাল/এ বিশ্বকে  এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ আমরাও চাই সুকান্তের মতো মানুষের সমাহার। যারা তার কথার রেশ ধরে দেশের সব শিশুর জন্য বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এগিয়ে আসবেন তারা। আমরা সব শিশুর নিরাপদ বাসযোগ্য পরিবেশ এখনো গড়ে তুলতে পারিনি। এ দায় শুধু রাষ্ট্র বা সরকারের একার নয়, আমাদের তথা সমাজের সবার। এ থেকে দায়মুক্ত হতে হলে রাষ্ট্র, সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি দেশের নাগরিক সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। শুধু নিজের সন্তান বা নিজের শিশুর দিকে নয়, বাসার কাজের শিশুটিসহ আশ-পাশের সব শিশুর প্রতি মানবিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।

সমাজ থেকে শিশু নির্যাতন কিংবা শিশু ধর্ষণকারীদের উত্খাত করতে আমাদেরও সোচ্চার হতে হবে। যেখানে এ ধরনের জঘন্য ঘটনা ঘটবে সেখানেই গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিশু নির্যাতনকারীদের চিহ্নিত করে সমাজ থেকেও বিচ্যুত করার ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আইনের কোনো ফাঁক দিয়ে যাতে অপরাধীরা বের হয়ে যেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।