সারাবিশ্বের পাশাপাশি উগ্র জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা হিসেবে গণ্য হতে যাচ্ছে। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক যে উগ্রবাদী হামলা ঘটছে তা মানুষকে অসহায় করে তুলছে। মানুষ এর সুরাহা চায়। এ থেকে মুক্তি চায়। সে জন্য সরকার যে পদক্ষেপ নেবে তাতে কারো আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে কঠোর নজরদারি এবং সামাজিক প্রতিরোধই পারে জঙ্গি ও সন্ত্রাস নির্মূল করতে। বর্তমান সরকার জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে নানা পদক্ষেপ অব্যাহত রাখলেও সংকট পিছু ছাড়েনি। গত ১ জুলাই শুক্রবার গুলশানের হোটেল আর্টিজানে এবং ঈদুল ফিতরের দিন (০৭ জুলাই) শোলাকিয়ায় ঈদগাহ ময়দানের পাশে জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক ইতিহাসের যে ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেছে তা পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। শুধু বাঙালিরা নয়, সারা বিশ্ব এ ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে এ ধরনের ঘটনা বিশ্ববাসীকে নতুন বার্তা দিয়ে গেলো। তবে আশার কথা হলো সরকার বিষয়গুলোকে যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করছে এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অকুতোভয় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

 যে মুহূর্তে বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে অনেকের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে সে সময়ে এ ধরনের ঘটনা আমাদেরকে বেদনাহত করে। দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলেছে, মানুষের মাথাপিছু আয় ও ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে, রিজার্ভ বিশ্বের অনেক দেশের কাছে ঈর্ষণীয়, বিদ্যুতে ব্যাপক উন্নতি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নয়ন, বিদেশি বিনিয়োগের ইতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি, দেশে বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তখন এ ধরনের ঘটনা দেশকে পেছনে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্তের অংশবিশেষ। এ ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গি তত্পরতা বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে। এই অপতত্পরতা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রগতিশীল জনগণের কাম্য হতে পারে না। দেশের সুসময়কে দুঃসময়ে পরিণত করার জন্য যারা এ ধরনের নোংরা অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সাপেক্ষে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
 হোটেল আর্টিজানের এ ঘটনাটি বাংলাদেশের জন্য নতুন হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ঘটনার ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের নামও ঐ ধরনের নোংরা হামলার তালিকায় উঠে এলো। তাও আবার আমার দেশে জন্ম নেওয়া কিছু বিপথগামী তরুণের কারণে। এ ধরনের ঘটনা কোনো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকের কাছ থেকে আশা করা যায় না। যারা এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের প্রত্যেককেই আজ আইনের আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক শক্তির মদদ থাকলে তাদের বিষয়েও সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার। যারা আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যোগসাজশে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে বাংলাদেশের মুখে চুনকালি দিচ্ছেন তাদের শাস্তিদানের পাশাপাশি মুখোশ উন্মোচন হওয়া এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের মানুষ কখনোই উগ্রবাদীদের প্রশ্রয়দানের পক্ষে নয়। এ দেশের মানুষ যেমন শান্তিপ্রিয় তেমনি যে কোনো অন্যায়-অত্যাচারে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পিছপা হয় না। সুতরাং জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকার যে পদক্ষেপ নেবে তার সঙ্গে শতভাগ মানুষ থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। একই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো তত্পর হতে হবে। বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যে সক্ষমতা রয়েছে সেটা যদি যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা খুব সহজ। যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর সশস্ত্র হামলার মুখে বীরদর্পে দাঁড়িয়েছিল সেই একই বাহিনীর সদস্যরা জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে দাঁড়াবে এ বিশ্বাস বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণের।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছু বিষয়ে নজর দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আমার মনে হয়, জঙ্গিবাদ নিয়ে রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি না করে সরকারের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা প্রয়োজন সকল রাজনৈতিক মহলের। এই মুহূর্তে সরকারের পদত্যাগের চেয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকে সহযোগিতা করে আগামীতে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্য নিয়ে এগোনো দরকার। এটা মনে রাখতে হবে যে, জঙ্গি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এ সরকারের যে জোরালো অবস্থান সেটা পূর্ববর্তী সরকারগুলোর আমলে দেখা যায়নি।
জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় পরিবার থেকে তত্পরতা শুরু করতে হবে। সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। সন্তান কোথায় যায়, কাদের সাথে মেলামেশা করে এগুলো শুরু থেকেই বাবা-মা খেয়াল রাখলে এবং তাদের বিভিন্ন বয়সক্রমিক চাহিদার বিষয় নজরে রাখলে সন্তান বাবা-মায়ের নাগালের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পাবে না। সন্তানের আচরণে কোনো অসামঞ্জস্যতা দেখা গেলে প্রয়োজনে কাউন্সিলরের শরণাপন্ন হয়ে সমস্যা ছোট থাকতেই সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। সে সব ঘটনায় শত শত মানুষ হতাহত হয়। কিন্তু ঐসব দেশের বিরোধী রাজনৈতিক মহল বা সুশীল সমাজ কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির বদলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ্ঐ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আজ সময় এসেছে জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। সরকার যেখানে জঙ্গি ঘটনায় জিরো টলারেন্স দেখাতে বদ্ধপরিকর সেখানে জনগণ আস্থা রাখে এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকার। পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের উচিত দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এর পাশাপাশি নজর রাখতে হবে কোন্ এলাকায় কারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বা মদদ দিচ্ছে। চিহ্নিত জঙ্গিদের শাস্তিদানের পাশাপাশি যেন নতুন কেউ জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। শান্তিকামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দলমত নির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সরকারের নজরদারির পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও জনগণের যৌথ ভূমিকাই আমাদের এ বিভীষিকা থেকে মুক্তি দিতে পারে।