বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদের উত্থান ও বাংলাদেশ সরকারের জিরো টলারেন্স, স্বদেশ খবর
অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন আরা লেখা : সারাবিশ্ব উগ্র জঙ্গিবাদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ার কারণে বর্তমানে জঙ্গিবাদ পৃথিবীব্যাপী একটি বড় সংকটে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের উন্নত এবং ক্ষমতাবান দেশগুলোকে জঙ্গিবাদের আতঙ্ক রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বৃহৎ পরাশক্তিগুলো জঙ্গিবাদী বা উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মোকাবিলায় তৎপর হলেও ফ্রান্সের মতো একটি রাষ্ট্রে যখন উগ্রগোষ্ঠী নির্বিচারে হামলা চালায়, তখন আঁতকে উঠতে হয় পুরো বিশ্বকে। যখন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলার টার্গেটে থাকে, তখন আমাদের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের অধিবাসীরাও কমবেশি আতঙ্কগ্রস্ত হন। তবে বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদের যে ভীতি ঘরে ঘরে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, বাংলাদেশ বোধহয় তার চেয়ে কিছুটা নির্ভার। এক্ষেত্রে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে বর্তমান সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ জনগণকে আশ্বস্ত করেছে।
আমরা যদি কয়েক বছর পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে কী দেখব? দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা, আদালত, বিভিন্ন সমাবেশে গ্রেনেড ও বোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। এই ভয়াবহ হামলা আমাদেরকে শুধু বিস্মিতই করেনি, আতঙ্কিতও করেছিল। জঙ্গিবাদ মতাদর্শী বিভিন্ন সংগঠনের উত্থান একসময় পুরো জাতিকে আতঙ্কিত করলেও আজ এ ধরনের আতঙ্ক অনেকটা দূর হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সে আতঙ্ক এখন আর আগের মতো তাড়িয়ে ফেরে না জনগণকে। এজন্য দেশের রাজনৈতিক মতাদর্শ ভুলে দেশের আপামর জনতার সাধুবাদ বর্তমান সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিঃসন্দেহে পেতে পারেন।
বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। এই দেশে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ একইসঙ্গে বাস করে। এ দেশের মানুষ যেমন ধর্মপ্রাণ, তেমনি উদার। আনন্দ-উৎসবে সবাই হাত ধরাধরি করে চলে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মেলবন্ধন বাংলাদেশের জন্য গৌরবজনক। এই দেশে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তাতে সাম্প্রদায়িক চেতনা কখনোই বিস্তার লাভ করতে পারেনি। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতেই বাংলাদেশের জন্ম। সে কারণে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাথা তুলে দাঁড়ায় সকল অপশক্তির বিনাশে। এমন একটি দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তারে নানামহল নানা অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের সেই অপচেষ্টার কারণে অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। অনেকে আহত হয়ে পঙ্গুত্বের জীবন কাটাচ্ছেন। অনেক পরিবার এখনো প্রিয়জন হারানোর বেদনায় যন্ত্রণাদগ্ধ হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার জঙ্গিবাদ দমনে যে ঘোষণা দিয়েছে বা যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা বাংলাদেশকে বড় রকমের বিপদ থেকে রক্ষা করছে বলা যায়। অভ্যন্তরীণ-আন্তর্জাতিক জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর টার্গেটকে তুচ্ছ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু স্বদেশ ও জনগণের জন্য অহর্নিশ অপশক্তির বিরুদ্ধে যে লড়াই করে চলেছেন তার নজির খুব বেশি পাওয়া যাবে না।
তবে সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে জোরালোভাবে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে কোনো উগ্রপন্থাই ভালো কোনো কিছুর জন্ম দিতে পারে না। বরং সমাজে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে পুরো সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। আর এই উগ্রপন্থাকে যারা সমর্থন জোগাবে বা পৃষ্ঠপোষকতা দেবে তারা প্রকারান্তরে সমাজ ও রাষ্ট্রকে পেছনের দিকেই নিয়ে যাবে। সুতরাং উগ্রবাদী তথা ধর্মীয় লেবাসে যারা জঙ্গিবাদের জন্ম দিচ্ছে, লালন বা পৃষ্ঠপোষকতা করছে তাদেরকে একযোগে বয়কট করার সময় এসেছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সে বাংলাদেশ যেন কোনো অপশক্তির নগ্ন থাবায় ক্ষতবিক্ষত না হয় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রতিটি জনগণের। সেজন্য সমাজের সকল স্তর থেকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মকা- শুরু করতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায়, জঙ্গি কার্যক্রমে যাদের ব্যবহার করা হয় তাদের খুব অল্প বয়সেই ধর্মের দোহাই দিয়ে এই সকল কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করানো হয়। তাদের বোঝানো হয়, এটা হচ্ছে ধর্মযুদ্ধ, আত্মঘাতী হামলায় নিজের মৃত্যুই পরকালের একমাত্র মুক্তির পথÑ এই আদর্শে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। অথচ তারা বুঝতেই পারে না যে তারা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। এক পর্যায়ে তারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং আত্মঘাতী হামলায় অংশ নেয়। যাদের এইভাবে বলিরপাঁঠা বানানো হচ্ছে তারা আমাদেরই কারও সন্তান বা ছোট ভাই সর্বোপরি তারা বাংলাদেশেরই নাগরিক। তাঁদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। প্রতিটি বাবা-মাকে তাদের নিজেদের সন্তানদের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে, তারা সত্যিকার অর্থেই সুশিক্ষা পাচ্ছে কি না এবং যেন কোনো অপরাধমূলক কর্মকা-ের সাথে নিজেকে না জড়িয়ে ফেলে সে দিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। এছাড়াও সরকারের পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এনজিও ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সভা-সেমিনারের আয়োজন করে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যেন এই কর্মকা-ের সাথে জড়িতদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।
মনে রাখতে হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও কল্যাণময় রাষ্ট্র রেখে যেতে হলে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সব অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। দল-মত বা কোনো রাজনৈতিক আদর্শের দোহাই দিয়ে মৌলিক কোনো লড়াই থেকে আমরা দূরে থাকলে তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যই ক্ষতি বয়ে আনবে। সেই ক্ষতি আমরা হতে দিতে পারি না।
লেখক : উপ-উপাচার্য,
উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।