বাংলাদেশের উন্নয়নে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও আজ সমান তালে অবদান রাখছে। বিভিন্ন পেশায় নারীরা তাদের দক্ষতা প্রমাণ করছে। সরকারও নারীসমাজকে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। এই পরিস্থিতিতে নারীরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহায়তা না পেলে তাদের এগিয়ে চলার পথ যেমন রুদ্ধ হবে, তেমনি সরকারের পদক্ষেপও ব্যাহত হবে। সরকার যেভাবে সর্বস্তরে নারীদের এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে তার জন্য চাই সমাজ ও রাষ্ট্রের সব স্তরের সহযোগিতা। আর এই সহযোগিতার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল পদে থেকে যাঁরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন তাঁদের চিহ্নিত করতে হবে এবং প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। তাহলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের স্বপ্ন পূরণ হবে।বাংলাদেশে নারীসমাজের উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। নারীশিক্ষা থেকে শুরু করে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও তাঁর যে পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ, তা বাংলাদেশের নারীকুলকে আশান্বিত করে। ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার সঙ্গে লড়াই করে বা ধর্মের নামে উগ্র চেতনাকে অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশের নারীরা গত কয়েক বছরে যে পর্যায়ে নিজেদের নিয়ে গেছে, তা কিন্তু রাষ্ট্রের সমর্থন ও সাহসিকতার কারণে সম্ভব হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি এ ক্ষেত্র তৈরির জন্য দেশের নারী সংগঠনগুলোর ভূমিকাকেও খাটো করে দেখা যাবে না। 

এর পরও নারীদের সহায়তার ক্ষেত্রে কোনো কোনো মহলের অনীহা বিস্ময়কর। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সব মহল থেকে নারীরা এখনো সমান সহযোগিতা না পাওয়ার ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বহুল প্রচারিত একটি বাংলা দৈনিকে গত ২৫ অক্টোবর ‘ব্যাংকঋণ পান না নারী উদ্যোক্তারা’ শীর্ষক একটি সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে, রোকসানা পারভীন নামে একজন নারী উদ্যোক্তা চলতি বছরের জানুয়ারিতে পাঁচ লাখ টাকা ঋণের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় আবেদন করেছিলেন। ব্যাংক যাচাই-বাছাই শেষে ছয় মাস পর তাঁকে দুই লাখ টাকা ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি রাজি হন। কিন্তু শাখা ব্যবস্থাপক (ব্রাঞ্চ ম্যানেজার) পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় তাঁর ঋণ আটকে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজশাহী অফিস ও ন্যাশনাল ব্যাংকের ওই শাখায় ঘোরাঘুরি করেও ঋণের দেখা পাননি তিনি। রোকসানা পারভীন পত্রিকাকে জানান, ব্যাংক থেকে তাঁকে বলা হয়েছে রাজশাহীতে কোনো নারী উদ্যোক্তাকে ঋণ দেওয়া হবে না।

শুধু রোকসানা পারভীন নন, নারী উদ্যোক্তা মিনারা বেগম, রাবেয়া খাতুন, দীপা মজুমদার, সাদিয়া তাজমিন দোলা ও সাবরিনা ইয়াসমিনও প্রায় একইভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়। সিলেটের নারী উদ্যোক্তা মিনারা বেগম দুটি বিউটি পার্লার ও একটি গরুর খামারের বিপরীতে ১০ লাখ টাকা ঋণের জন্য একটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছিলেন বলে জানা যায়। ঋণের জন্য সিলেট শহরের বাড়িও বন্ধক রাখার প্রক্রিয়া শেষ করেন। কিন্তু ঋণ পাননি তিনি। রাবেয়া খাতুন এসএমই ঋণের জন্য আবেদন করেও সহযোগিতা পাননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে। নারী উদ্যোক্তা দীপা মজুমদার, সাদিয়া তাজমিন দোলা ও সাবরিনা ইয়াসমিন চাহিদামতো সব কাগজপত্র ব্যাংকে জমা দেওয়ার পরও ঋণ পাননি। আজ-কাল করতে করতে ব্যাংকগুলো তাঁদের অনেক ঘুরিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই পত্রিকায়।

অথচ শিল্পনীতি ২০১৬-তে বলা হয়েছে, এসএমই খাতে ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও নির্দেশনা রয়েছে, পুনরর্থায়ন ঋণের কমপক্ষে ১০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দিতে হবে। গত জুন পর্যন্ত মেয়াদে মাত্র ৫ শতাংশ ঋণ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে দেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে, চলতি বছরের ছয় মাসে এসএমই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে গেছে তিন হাজার ৮২ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

সংবাদপত্রে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি যে অসহযোগিতা তা নারী উন্নয়নের পথে অন্তরায়। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নারী উদ্যোক্তাদের যেভাবে অসহযোগিতা করছে তা সরকারের সদিচ্ছাবিরোধী। এই নেতিবাচক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা জড়িত থাকবেন তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হলে নারী উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

যেখানে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই নারী, সেখানে তাদের উন্নয়নের ধারা থেকে বাইরে রেখে বাংলাদেশের যথাযথ উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ ও পদক্ষেপ সফল করতে হলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বড়মাপের সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ব্যাংকগুলোকে আরো বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। নারীদের জন্য ঋণ প্রদানের পদ্ধতি আরো সহজতর ও সময়োপযোগী করতে হবে। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো উদ্যোক্তা নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে যখন ঋণ পান তখন তা তাঁর ব্যবসার কাজে লাগে না। সে সময় পরিবারের সদস্যদের চাপে বা মায়ায় তিনি তা অন্য খাতে খরচ করে ফেলেন। ঋণ শোধ করার সময় তাঁকে বেগ পেতে হয়, যা উদ্যোক্তাদের জন্যও অশুভ ফল বয়ে আনছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের পরিকল্পনা সফল করতে নারী উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবসাক্ষেত্র নির্ধারণ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে বিউটি পার্লার, নারী ও শিশু পোশাক তৈরি, গৃহস্থালি সামগ্রী, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পজাত পণ্য উত্পাদনের ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করা যেতে পারে।

সরকার যেভাবে সর্বস্তরে নারীদের এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য চাই সমাজ ও রাষ্ট্রের সব স্তরের সহযোগিতা। আর এই সহযোগিতার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল পদে থাকা যাঁরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন তাঁদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের স্বপ্ন পূরণ হবে।

লেখক : উপ-উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *