‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’ -নারী ও পুরুষকে এভাবেই দেখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ইসলাম ধর্মসহ প্রায় সব ধর্মেই নারীকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নারী হলেন মায়ের জাতি। যে মায়ের গর্ভ থেকে আমাদের জন্ম সে মায়ের জাতিকে  যদি মর্যাদা না দেয়া হয় তাহলে তা কলঙ্কজনক। কোন সমাজ ও রাষ্ট্র কতটা সভ্য বা উদার তা নির্ভর করে সেখানকার নারীদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থানের উপর।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নারী উন্নয়নে ব্যাপক সক্রিয়। নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইতিবাচক ও আন্তরিক ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত। আর সে কারণে তার খ্যাতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন। যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য অতি সম্প্রতি পাওয়া ‘প্লানেট ফিফটি-ফিফটি’ ও ‘এজেন্ট অব চেইঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’। এ দুইটি অ্যাওয়ার্ড শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই নয়, পুরো দেশের অর্জন। শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছার কারণে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে নারীদের অবস্থান আগের চেয়ে সুসংহত হলেও সমাজে তার প্রভাব পুরোটা পড়েছে এটা বলা যাবে না।

এই সমাজেরই কিছু মানুষের কাছ থেকে নারীরা এখনো যথাযথ সম্মান পাচ্ছে না। তারা মনে করে পুরুষদের ইচ্ছার উপর নারীকে চলতে হবে। নারীদের আলাদা কোনো সত্ত্বা থাকবে না। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা এগিয়ে যেতে পারবে না। ধর্মের নাম নিয়ে যারা রাজনীতিতে সক্রিয় তারা যেমন নারীদের উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে নারাজ তেমনি অতি উগ্র ইসলাম পন্থিরাও নারীদের ক্ষমতায়নে বরাবর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইসলামে নারীদের কাজ করতে কোনো বাধা নেই। উল্লেখ্য, খাদিজা (রা.) একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন।

বিগত দুইদশকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এবং শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশে আইনী কাঠামো শক্তিশালী হয়েছে এবং সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে; কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, নারীদের প্রতি পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা খুব একটা কমেনি। বরং দিন যতো যাচ্ছে পরিবারে ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীরা নানা সংকটে পড়ছেন। রাষ্ট্র বা সরকার নারীদের মর্যাদা রক্ষার জন্য নানা উদ্যোগ নিলেও সমাজ ও পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টানোতে নারীরা অনেকের সঙ্গে থেকেও অসহায় বোধ করেন। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতা বা সংকটের শিকার অনেক নারী আইনের আশ্রয়ও নিতে ভরসা পান না।

নারীরা সাধারণত কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, ফতোয়া, এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন। গৃহকর্মে নিয়োজিত নারীরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন হরহামেশা। পুরুষের নির্যাতনের শিকার হয়ে নারীদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। এর সব ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মতো অনেক আইন রয়েছে; কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গাফিলতি ও ঘটনার সাক্ষীদাতার অভাবে নারীর প্রতি সহিংসতাকারীরা বারবার মুক্ত হয়ে যান। আর মুক্ত হওয়ার পরে তারা আবার আগের মতো অপরাধ করছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, খাদিজা নার্গিসের কথা। গত ৩ অক্টোবর সিলেট এমসি কলেজের পরীক্ষা হল থেকে বের হওয়ার পথে চাপাতি দিয়ে খাদিজাকে কুপিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগ নেতা বলে পরিচিত শাবি ছাত্র বদরুল আলম। ঘটনাটি নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রধানমন্ত্রী তার চিকিত্সার ব্যয় ভারসহ সকল বিষয়ে মনিটরিং করছেন এবং খাদিজার অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে।

এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর কিশোরী নিতু মণ্ডল স্কুলে যাওয়ার পথে বখাটের হাতে খুন হয়। এই ঘটনার ঠিক ২৪ দিন আগে রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিসাকে স্কুলের সামনের ওভারব্রিজে কুপিয়ে আহত করে আরেক বখাটে। চার দিন পর ঢাকা মেডিক্যালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যায় রিসা। তারও আগে কুমিল্লা সেনানিবাসের পাশে অপহরণের পর খুন হন শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক কর্মী সোহাগী জাহান তনু। এভাবেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বখাটেদের হাতে খুন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারীরা।

আর এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক পুরুষেরও প্রাণহানি ঘটছে। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় গত কিছুদিনে পাঁচজন পুরুষকে খুন করেছে বখাটেরা। লাঞ্ছিত হয়েছেন ৮২ নারী ও ১৬ জন পুরুষ। এসব ঘটনায় আঘাতের শিকার হয়েছেন ৫৭ জন পুরুষ। বখাটেদের উত্পাতে চার জন ছাত্রীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে এ তথ্য জানা যায়।

আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, গত আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে বখাটেদের উত্পাতে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ১৬৯টি। এসব ঘটনায় আত্মহত্যা করেছে তিন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছে তিন ছাত্রী। আসকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে বখাটেদের মাধ্যমে ৩২০টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছে পাঁচজন নারী ও একজন পুরুষ। অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ১০ জন নারী। কয়েক বছর আগে যৌন হয়রানি ও ইভটিজিংয়ের বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে এবং এ নিয়ে তখন সচেতনতামূলক প্রচারণাও হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আট বছরে সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৩৮ হাজার ৪৯৮টি। এর মধ্যে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ৫১৭টি, অপহরণের ঘটনা ১ হাজার ৫৪৫, উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে ৩ হাজার ৭৮০ জন নারী। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে ১৩৮ জন। ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট বিভাগ যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি নির্দেশনামূলক রায় দেন। এই রায়ে মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ সর্বস্তরে নারীর ওপর যৌন হয়রানিমূলক আচরণ প্রতিরোধে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কেউ অশোভন আচরণের শিকার হলে কাছের থানায় বা দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাকে জানাতে পারেন। অনলাইনের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হলে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করার সুযোগ রয়েছে।

আবার দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী কোনো নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার ইচ্ছায় কোনো মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি বা যেকোনো ধরনের কাজের শাস্তি এক বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন অধ্যাদেশের ৭৬ ধারা অনুযায়ী, নারীদের উত্ত্যক্ত করার শাস্তি কমপক্ষে এক বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, যৌন কামনার উদ্দেশ্যে কোনো অঙ্গ স্পর্শ করলে বা শ্লীলতাহানি করলে সর্বোচ্চ ১০ বছর সাজা এবং সর্বনিম্ন তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এরপরও এক্ষেত্রে যে খুব বেশি ফল এসেছে তা বলা যাবে না। তবে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

ইভটিজিং, যৌন হয়রানিসহ নারী সমাজ প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে পুরুষ দ্বারা যেভাবে নির্যাতিত হন তার মাত্রা দিনে দিনে কমে এলেও এখনো নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। সরকারের উদ্যোগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা নারী সমাজকে আগের চেয়ে এগিয়ে দিলেও পুরুষদের একাংশের কাছে নারী এখনো ভোগের সামগ্রী। পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রে নারী সমাজ তাদের কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পুরোপুরি পাচ্ছে- এখনো এমনটি বলা যাবে না। মূলত সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারীদের উপর সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে প্রথমে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নারী নিজ পরিবারেই নির্যাতিত হচ্ছেন বেশি। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না। ফলে সহিংসতার শিকার হয়েও তারা বাধ্য হয়ে সহ্য করছেন।

এই অবস্থার পরিবর্তনে চাই ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এ নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও বিতর্ক হতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কর্মসূচি পরিচালনার উদ্যোগ নিতে পারে। এদেশের বিভিন্ন নারীবান্ধব সংগঠনকে আরো বেশি বেশি করে কর্মসূচি পরিচালনা করা প্রয়োজন। শুধু একটি ঘটনা বা একটি দিবসকে কেন্দ্র করে কর্মসূচি পালন না করে বিভিন্ন ইস্যুতে নিয়মিত কর্মসূচি থাকা উচিত।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে ‘নারী সমাজের প্রতি করণীয় ও নারীদের সম্মান করলে সমাজ ও রাষ্ট্র কিভাবে উন্নত হতে পারে তার বর্ণনা দিয়ে একাধিক রচনা থাকতে পারে। পরিবারের বয়স্কজনেরা নিজ নিজ পরিবারে নারীদের মর্যাদার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। আলেমগণ যদি নারীদের মর্যাদা রক্ষায় করণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরেন তাহলে তা সমাজের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। আমি মনে করি- সরকারের পাশাপাশি সমাজ এবং পরিবারকেও এগিয়ে আসতে হবে নারীর উন্নয়নে। আর পুরুষদের মনে রাখতে হবে দেশের বা বিশ্বের নারীদের প্রতি সম্মান দেখালে মা-বোন বা কন্যার প্রতি সম্মান দেখানো হবে।