‘পুলিশ’ শব্দটা শুনলেই অনেকের মনে আতঙ্ক কিংবা ভয়ের উদ্রেক হয়। কেউ বা আবার ঘৃণা বা বিরক্তিতে মুখ বেঁকিয়ে ফেলেন। ওই কেউ কেউই আবার তাদের আপনজনের পুলিশের চাকরি পাওয়াতে ভীষণ আনন্দিত হন। এই দ্বৈত অনুভূতি নিয়েই আমাদের সাধারণের দৃষ্টি পুলিশ এবং পুলিশি ব্যবস্থার দিকে। ভারতীয় উপমহাদেশে পুলিশি ব্যবস্থার প্রচলন সুপ্রাচীনকাল থেকেই। এমনকি পুরাণ ঘেঁটেও পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনকারী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব। মধ্যযুগে মুঘল সাম্রাজ্যের সময় থেকেই একদল ব্যক্তি পুলিশের মতো দায়িত্ব পালন করতেন কিন্তু আধুনিক পুলিশি ব্যবস্থাপনার উদ্ভব ভারতীয় উপমহাদেশে ঘটে ব্রিটিশ আমলে। মূলত সিপাহি বিদ্রোহের পর এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের আগ্রহ বাড়ে এবং লর্ড ক্যানিংয়ের নেতৃত্বে ১৮৬১ সালে সংসদে এই ব্যবস্থা গৃহীত হয়। পুলিশের কার্যক্রম ও কর্মপরিধি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট। কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের নিরাপত্তা বিধান এবং প্রশাসনিক সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব পালন করাই পুলিশের প্রধান কাজ।

বাংলাদেশে পুলিশি সংস্থার সূচনা হয় ভারত বিভক্তির পরপরই। প্রাথমিকভাবে নামকরণ হয় ‘ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ’, পরে নাম বদলে রাখা হয় ‘ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ’, যা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করে এবং অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী জীবন উৎসর্গ করেন। বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশের নাম হয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ’। জনগণের সেবায় সরকারি চাকরি হিসেবে ভীষণ জনপ্রিয়তা পায় এই পেশাটি। কিন্তু সব পেশার মতোই এই পেশাতেও কিছু নীতিহীন, দুর্নীতি মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তির অনুপ্রবেশ পেশাটিকে কলঙ্কিত করেছে অনেক সময়। পুলিশি ব্যবস্থার সূচনায় যেমন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দমনের প্রয়াস ছিল, সেই মনোভাব রয়ে যাওয়ায় অনেক সময় সরকারি দলের পক্ষে অবস্থান করার অভিযোগেও পুলিশি প্রশাসন দায়বদ্ধ হয়।

কথায় আছে, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’, যার সহজ মানে হলো পুলিশ বাঘের থেকেও ভয়ংকর। প্রবাদ হিসেবে এই কথাকে অস্বীকার করার সুযোগ না থাকলেও আমরা একটু ভিন্ন চোখেও তাকাতে পারি বাংলাদেশ পুলিশের দিকে। উত্থাপিত অভিযোগগুলোকে অস্বীকার না করেই আমরা একটু ভিন্নভাবে দেখতে পারি বাংলাদেশ পুলিশ ও পুলিশি প্রশাসনের দিকে। বর্তমানে লক্ষাধিক মানুষ বাংলাদেশ পুলিশে নিয়োজিত রয়েছে। তারা কোনো না কোনোভাবে আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা জানাশোনা। তাদের রয়েছে পরিবার ও আপনজন। কিন্তু সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা তাদের ভিনগ্রহের মানুষের মতো বিবেচনা করি এবং সেই বিবেচনার বেশির ভাগটাই নেতিবাচক।

অন্যান্য পেশার থেকে পুলিশের সাধারণ সদস্যদের কর্মঘণ্টা বেশি, দায় ও দায়িত্ব বেশি এবং তাদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা কম। ট্রাফিক পুলিশের কথাই ভাবুন না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তারা রাস্তায় রাস্তায় ডিউটি করে। রোদ, বৃষ্টি, গরম সবকিছুকে উপেক্ষা করে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। হ্যাঁ, তাদের শিফট থাকে, তাদের বিরতি থাকে কিন্তু সেটা অন্য যেকোনো পেশার থেকে কম। পথে ডিউটির সময় তাদের খাবার কিংবা টয়লেট ব্যবহারের সুবিধা কতটুকু রয়েছে তা নিয়ে আমাদের কি কোনো ভাবনা রয়েছে? ট্রাফিক পুলিশ কোনো গাড়িকে থামালেই আমরা অনেকেই মুখে না বললেও মনে মনে একটা গালি দিয়ে দিই, অথচ গাড়ির মালিক থেকে চালক পর্যন্ত যে বেআইনি কাজটি করছে তার প্রতি আমাদের খেয়াল হয় না।

পুলিশের সবগুলো বিভাগই দিনরাত কাজ করে যায়। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ বাণী নিয়ে কাজ করেও, আধুনিকায়ন এনেও, দুর্নীতির হ্রাস ঘটিয়েও জনগণের আস্থা অর্জনে যথেষ্ট হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশকে। অথচ যেকোনো আইনি জটিলতা কিংবা অপরাধের সম্মুখীন হলে আমরা প্রথমেই পুলিশের শরণাপন্ন হই। সকাল কিংবা মাঝরাত যখনই প্রয়োজন হোক পুলিশই সর্ব প্রথম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সরকারি সেবা হিসেবে ৯৯৯ নম্বরে কল করে যেকোনো মুহূর্তে পুলিশের সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে দ্রুত সময়ে। যারা পুলিশে নিয়োজিত তাদের তাই সকাল হোক কিংবা মাঝরাত, বলামাত্র দায়িত্বে নিয়োজিত হতে হয়। অথচ তাদের পরিবারের মানুষরা তাকে কাছে পায় না পর্যাপ্ত সময়ের জন্য। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এ তো ঘটা করে বলার কী আছে! তারা তো এর জন্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। আপনার বক্তব্য ভুল না কিন্তু তাই বলে কি একটি মানুষের সারা দিন দায়িত্ব পালন করা আর নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টায় কাজ করাকে আপনি একই রকম বিবেচনা করবেন?

কাজ এবং পারিশ্রমিকের পরও আরও কিছু বিষয় থেকে যায়। যেমনজীবনের নিরাপত্তা। পুলিশে চাকরি করলেই কোনো ব্যক্তি যে সার্বক্ষণিক নিজস্ব নিরাপত্তা পান তার কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। যেহেতু পুলিশের কার্যক্রমই অপরাধ জগতের সঙ্গে সেহেতু যেকোনো উপায়, যেকোনো মুহূর্তে তার ওপর কিংবা তার পরিবারের ওপর আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনকি কখনো কখনো কর্তব্যরত অবস্থাতেও তারা আক্রমণের শিকার হন। এই তো কিছুদিন আগেই মিরপুর ১০-এ ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকদের হামলায় গুরুতর আহত হন একজন পুলিশ সদস্য। সামাজিকভাবে অবজ্ঞা কিংবা এড়িয়ে চলার মতো মানসিক পীড়ন তো রয়েছেই।

সুতরাং বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে আমাদের সাধারণের দৃষ্টির অন্তরালেও রয়েছে এক জগৎ। খুব ঘটা করে পুলিশের নেতিবাচক বিষয়গুলোর উপস্থাপন প্রায়ই দেখা গেলেও তাদের প্রতি ইতিবাচক ভঙ্গিতে তাকানোর প্রয়াস আমাদের কমই। খুব কম প্রতিবেদনেই পুলিশ হিসেবে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, উত্থান-পতনের চিত্র উপস্থাপিত হয়। প্রতিটি পেশাতেই রয়েছে ভালো-খারাপের সংমিশ্রণ। খারাপের সংশোধন যেমন প্রয়োজন, ভালোর প্রশংসাও তেমনি অত্যাবশ্যক।

লেখক : উপ-উপাচার্য, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়

Original Link: https://www.deshrupantor.com/editorial-news/2023/01/19/403592/