প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করুন, যায়যায়দিন

প্রতিবন্ধীদের প্রতি অবহেলা নয়, তাদের প্রতি সব অবস্থাতেই সদয় হতে হবে। উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে মানবতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রাখতে হবে। তাহলে মানবাধিকার রক্ষা হবে, ধর্মের বিধানও মানা হবে। এমন দৃঢ় পদক্ষেপ রাখতে হবে যেন প্রতিবন্ধীরা উন্নয়ন কর্মকা-ের মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে পারে। শুধু প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন করেই সরকারের দায়িত্ব পালন শেষ করলে চলবে না। আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সবরকম ভূমিকা রাখতে হবে। সরকারের আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখছে কিনা তার প্রতি নজর রাখতে হবে।ড. ইয়াসমীন আরা লেখা কোন দেশ বা সমাজ কতটা কল্যাণকামী তা নির্ধারণের জন্যে যে কয়টি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয় তার অন্যতম একটি হলো মানবাধিকার। রাষ্ট্রের সুশাসনের ব্যারোমিটারও হলো ওই রাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি। এটা সত্যি যে বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়ে আসছে হরহামেশাই। বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনে মানবাধিকারের বিষয়টিকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হলেও সে অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সাফল্য রয়েছে সেটা বলা যাবে না। সমাজে বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার জনগণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রায়ই।
আজকের এ রচনায় সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত না করে আমি প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে কথা বলব। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন কাজ করে চলেছে। এর ফলে প্রতিবন্ধীরা এখন আগের তুলনায় তাদের অধিকার কিছু বেশি ভোগ করছে। কিন্তু দেশে থাকা প্রতিবন্ধীদের চাহিদা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মনোবেদনার তুলনায় সেটা অনেক কম। তবে আশার কথা হলো বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে বরাবরই সোচ্চার। তিনি উন্নয়ন কর্মকা-ে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে তার বিশেষ দৃষ্টি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবহেলিত এ গোষ্ঠীকে কতটা এগিয়ে দেবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

গত ৩ ডিসেম্বর ছিল ২০তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘উন্নয়নে সম্পৃক্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সবার জন্য সুন্দর এক পৃথিবী’। বিষয়টি অত্যন্ত সময়োপযোগী। বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা বিবেচনা করলে এ প্রতিপাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে দেড় কোটির ওপরে প্রতিবন্ধী রয়েছে। এ বিপুলসংখ্যক প্রতিবন্ধীর জীবনমান উন্নয়নের চিন্তা বাদ দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না। আর সে কারণে দেশের সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অবাধ অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করে দেয়া আজ সময়ের দাবি।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধী দিবসটি ‘যথাযোগ্য মর্যাদায়’ পালিত হয় প্রতিবছর। দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিকতায় আমরা যতটা ‘যথাযোগ্য মর্যাদা’ মেনে থাকি প্রতিবন্ধীদের বেলায় আমরা তা কতটা রক্ষা করি? আমরা কি পেরেছি প্রতিবন্ধীদের প্রাপ্য সামাজিক অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তার সুযোগ পুরোপুরি সৃষ্টি করতে? দেশের উন্নয়ন কর্মকা-ের মূলধারায় প্রতিবন্ধীদের মর্যাদার সঙ্গে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে? আমার মনে হয় দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বীকার করবেন আমরা এ ক্ষেত্রগুলোয় পুরোপুরি সাফল্য পাইনি। সে ক্ষেত্রে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টিকে শুধু আলোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে আমাদের প্রত্যেককে মর্মার্থ উপলব্ধি করে এগিয়ে আসতে হবে এর বাস্তবায়নে।
দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবন্ধীদের স্বার্থ সংরক্ষণের নানামুখী আন্দোলনের কারণে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে র‌্যাম্প স্থাপনের কাজটি অংশবিশেষ হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা স্কুলগুলো আগের তুলনায় কিছুটা উন্নত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঘোষণায় কিছু উদ্যোগের কথা এবং সরকারের বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু বরাদ্দ রাখা হয়েছে। জাতীয় প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন-২০১০ এর মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের আগের তুলনায় আরো বেশি অধিকার ও সুযোগ দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। কিন্তু তারপরও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় প্রতিবন্ধীদের তুলনায় আমাদের সব কর্মকা- ও পদক্ষেপ অনেক কম।
কিন্তু আমরা এখনো রাষ্ট্রের মূলধারার উন্নয়ন কর্মকা-ে প্রতিবন্ধীদের সম্পৃক্ত করতে পারিনি। প্রতিবন্ধীরা দেশের অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর সঙ্গে এক স্কুলে পড়তে পারছে না। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের কোটা রাখা হলেও স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে মিলে সরকারি বা বেসরকারি অফিস-আদালতে প্রতিবন্ধীরা কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্ম প্রতিষ্ঠান সব ক্ষেত্রেই এখনো প্রতিবন্ধীরা স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে সুযোগ প্রাপ্তিতে অনেক পিছিয়ে আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বা দেশীয় আইন, মানবাধিকার বা ইসলাম সবক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী ও স্বাভাবিক সবার সমান সুযোগ পাওয়ার কথা।
প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে আমরা যতটা কাজ করছি তার সুফল পুরোপুরি অর্জন করতে পারছি না ক্ষেত্রটিতে মনোযোগ না দেয়ার ফলে এবং প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাবে। দেশের প্রতিবন্ধীরা এখন যতটা অধিকার ভোগ করেন তার জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এনজিওর ব্যাপক ভূমিকার কথাটি বলতেই হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে তার বিশেষ মমত্ব প্রকাশ করায় এ সরকারের আমলে পরিস্থিতির তুলনামূলক উন্নতি হয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি। এ লক্ষ্য পূরণে প্রয়োজন আমাদের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান যে শুধু রাষ্ট্র করবে তা নয়, সমাজ ও ব্যক্তির উপরেও রয়েছে এ দায়িত্ব।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় বিশ্বের প্রায় ১০ ভাগ মানুষ প্রতিবন্ধী। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীর ঠিক হিসাব জানা না গেলেও দেড় কোটির ওপরে প্রতিবন্ধী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এ দেড় কোটি মানুষ মানে আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক দশমাংশ। দিনে দিনে এর পরিমাণ বাড়ছে বলে জানা যায়। বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে আমাদের দেশে নানা অসচেতনার কারণে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা এবং তাদের সমস্যার পরিমাণ বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় দেশে নারী প্রতিবন্ধীর সংখ্যা হলো ৮০ লাখ। যারা সবসময় পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। এ নারী প্রতিবন্ধীরা আবার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নানাভাবে। সুতরাং দেশের এ বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যাকে উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে আমরা নানা সমস্যার মুখে পড়ব।
এবারে আসা যাক, ইসলামে প্রতিবন্ধীদের অবস্থান প্রসঙ্গে। রাসূলুল্লাহের (স.) সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) ছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বা অন্ধ। একবার রাসূলুল্লাহের (স.) কাছে তিনি একটি প্রশ্ন করে তার তাৎক্ষণিক উত্তরের জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহের (স.) কাছে তার এ ধরনের আচরণ বিরক্তিকর ঠেকে। কিন্তু রাসূলুল্লাহের (স) এ অমনোযোগিতা ও বিরক্তিভাব আল্লাহর পছন্দ হলো না। সঙ্গে সঙ্গে সুরা আবাসার আয়াত অবতীর্ণ হয়। যার অর্থ হলো_ ‘তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কারণ তার কাছে এক অন্ধ আগমন করল। আপনি কী জানেন, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করত এবং উপদেশে তার উপকার হতো।’- সুরা আবাসা, আয়াত ১-৪। এ আয়াত নাজেল হওয়ার পর থেকে উম্মে মাকতুম যখনই রাসূলুল্লাহের (স) খেদমতে আসতেন তখনই তিনি বলতেন, ‘এসো এসো আবদুল্লাহ! তোমার জন্য আল্লাহ আমার ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।’ আল্লাহর কাছে প্রতিবন্ধীদের মর্যাদা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ এ ঘটনা তাই শিক্ষা দেয়। প্রিয় নবী (স.) উত্তম ব্যবহারকে সবচেয়ে সওয়াবের কাজ বলে ঘোষণা করেছেন। অন্য এক হাদিসে আছে ‘যে লোক মানুষের প্রতি দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হয় না।’
প্রতিবন্ধীদের প্রতি অবহেলা নয়, তাদের প্রতি সব অবস্থাতেই সদয় হতে হবে। উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে মানবতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রাখতে হবে। তাহলে মানবাধিকার রক্ষা হবে, ধর্মের বিধানও মানা হবে। এমন দৃঢ় পদক্ষেপ রাখতে হবে যেন প্রতিবন্ধীরা উন্নয়ন কর্মকা-ের মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে পারে। শুধু প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন করেই সরকারের দায়িত্ব পালন শেষ করলে চলবে না। আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সবরকম ভূমিকা রাখতে হবে। সরকারের আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখছে কিনা তার প্রতি নজর রাখতে হবে। আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ভূমিকা রাখব। সমাজের মূলধারায় প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত করতে সবাই মিলে উদ্যোগ নেব এ হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।