মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল হলো খাদ্য। সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে খাদ্যকে মৌলিক উপকরণ ও ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে খাদ্যকে জীবনের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খাদ্যে ভেজালের পরিমাণ এতটাই বেড়ে গেছে যে, তৈরি অথবা কাঁচা খাদ্য কোনোটির ওপরই মানুষ আর আস্থা রাখতে পারছে না। সমগ্র বিশ্বেই খাদ্যে ভেজালের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই প্রবণতা অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে ক্যান্সারসহ অন্যান্য প্রাণঘাতী অসুখের অন্যতম কারণ হচ্ছে ভেজাল খাদ্য। ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে মানবদেহে বাসা বাঁধছে বিভিন্ন অনিরাময়যোগ্য রোগ। এসব জটিল ও অনিরাময়যোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। একশ্রেণির মানুষের অতি মুনাফা ও লোভের কারণেই দিনে দিনে আমরা মৃত্যু ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তাই নিরাপদ খাদ্যের অধিকার ভোক্তাদের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, সরকারের জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দৈনন্দিন খাদ্যদ্রব্যে মারাত্মক রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সারাদেশ থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যে কেমিক্যাল ও কীটনাশকের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি করছে।

তাই এখন থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে মানবদেহে রোগ-ব্যাধি আক্রান্তের হার ভবিষ্যতে মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিত্সা বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন আগামী ২০ বছরের মধ্যে মানুষের মৃত্যুর ৭০ শতাংশ কারণ হবে ভেজাল খাদ্য গ্রহণ। এ ধরনের আশঙ্কা খুবই উদ্বেগজনক। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে বেশির ভাগ খাদ্যদ্রব্যই আমরা উত্পাদন করে থাকি। আবার বিশেষ কিছু খাদ্যদ্রব্য আমাদের আমদানি করতে হয়। নিজস্ব ও আমদানিকৃত কোনো খাদ্যদ্রব্যই ভেজালের আওতামুক্ত নয়। আমাদের শতকরা নব্বই ভাগ মৌসুমি ফল ও শাক-সবজিতে বিষ মেশানো হয়। একই ভাবে মাছ, গুঁড়া মসলা, শিশু খাদ্য, এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল এখন নৈমিত্তিক ঘটনা। নিত্য ব্যবহার্য এসব খাদ্যে ফরমালিন, কীটনাশক সহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হচ্ছে। ভেজাল প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অসত্ ব্যবসায়ীদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া উচিত নয়। কেবল জেল-জরিমানা নয় এর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা প্রয়োজন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে এর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভেজালের বিরুদ্ধে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তবে এটা সত্য যতদিন পর্যন্ত অসত্ ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন না হবে ততদিন পর্যন্ত এ প্রবণতা চলবেই। জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা জরুরি। খাদ্যপণ্যে ভেজাল জনগণের জন্যে এ মুহূর্তে প্রধান হুমকি। এ হুমকি রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সামাজিক সচেতনতার অভাবে তা কোনো কাজে আসছে না। আমরা জেনেশুনেই ভেজাল পণ্য গ্রহণ করছি। ভেজাল পণ্য বর্জন করে সাধারণ মানুষ অসত্ চক্রকে শিক্ষা দিতে পারে। তা ছাড়া ভোক্তা আইন সম্পর্কে জেনে প্রতারিত ব্যক্তি ভোক্তা অধিদপ্তর বরাবর অভিযোগ দায়ের করে ক্ষতিপূরণ আদায় অথবা দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেন। আশার কথা হলো রাজধানীতে ভেজাল বিরোধী অভিযান জোরদার করা হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যাও। এ অভিযান সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশকেও অভিযানে নামানো উচিত। খাদ্যদ্রব্যে যারা বিষ মিশিয়ে সজ্ঞানে জনস্বাস্থ্যকে হুমকি বা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় তারা খুনি। এই খুনি চক্রকে দমন করার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন জরুরি। তাই প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের যেমন কঠোর শাস্তির বিধান আছে তেমনই পরোক্ষভাবে একটি বিশেষ সময়ের জনগোষ্ঠীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া অপরাধের জন্য আরও কঠোর ও দ্রুত আইনে বিচারের ব্যবস্থা করা জরুরি। সরকার, ভোক্তা অধিদপ্তর ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, প্রতিরোধ, কঠোর ও দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিতকরণই পারে এই ঘৃণ্য কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখতে।

লেখক : উপ-উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি