বীজ থেকে যেমন গাছের সৃষ্টি হয় তেমনি ভ্রূণ থেকে মানব শিশুর সূচনা হয়। সৃষ্টির সব জীবই কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় পৃথিবীর আলো বাতাসের উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠে। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হলেও সে সবচেয়ে বেশি অসহায়ত্ব নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। অন্যের অবলম্বন ব্যতিরেকে সে নিজেকে পৃথিবীতে বসবাসের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে না। পরম মমতা ও যত্নে একটি শিশুকে ধীরে ধীরে বড় করে তুলতে হয়। উপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যাতেই তার যথাযথ বিকাশ ঘটে। শিক্ষাবিদ ফ্রয়েবল শিশুদের চারা গাছের সাথে তুলনা করে চারা রূপ শিশুকে পরিচর্যা করার জন্যে শিক্ষক এবং মা-বাবাকে মালীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বলেছেন। সত্যিই যদি একটি চারা গাছকে ঠিকভাবে পরিচর্যা করা না হয়, ঝড়বৃষ্টি, পশুপাখি থেকে রক্ষা করার জন্যে চারদিকে আগল বা বেড়া দেয়া না হয় তাহলে ঐ গাছটি চারা পর্যায়েই বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু যথাযথ পরিচর্যায় বড় করে যদি গাছটিকে পূর্ণাঙ্গ গাছে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে ঐ গাছটি এক সময় ফুল ফল দিয়ে সুশোভিত হয়ে মানুষের উপকারে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। এক সময় গাছটি মহীরূহে পরিণত হয়ে মানুষকে ছায়া দেয়, পাখ-পাখালিকে আশ্রয় দেয় অর্থাত্ ঐ গাছটি সম্পদে পরিণত হয়। ফ্রয়েবলের Plant-gardener theory অনুযায়ী একটি শিশুকে দেখলে, গাছের মতই যথাযথ পরিচর্যায় শিশুকে তৈরি করতে পারলে, শিক্ষকের সাথে বাবা-মা, ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সমাজের সবাই পরিচর্যায় আগল তথা বেড়া তৈরি করে ঐ সব শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে ফলভারে অবনত বৃক্ষের মতই পরিপূর্ণ মানব সম্পদে রূপান্তরিত হয়ে সে দেশের কল্যাণে নিজের অবদান প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে।

জন্মের পর বাবা মা ও পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় একটি শিশুর বিভিন্ন দিকের বিকাশ ঘটে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শিশু কথা বলতে শেখে, ভাষা আয়ত্ত করে, সামাজিক রীতি নীতি শেখে। শিখনের প্রতিটি পর্যায়ে পিতা মাতা ও পরিবারের সদস্যদের সতর্ক দৃষ্টি রেখে শিশুকে এমনভাবে পরিচালনা করতে হয় যাতে করে শিশুটির বিকাশ কোন নেতিবাচক দিকে মোড় নিতে না পারে। পরিমিত আদর শাসন শিশুর জন্যে মঙ্গলজনক। অতি আদরে যেমন শিশু প্রশ্রয় পায়, তেমনি অতি শাসনে সে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। চারা গাছকে যেমন বেড়া না দিয়ে চার দেয়ালে বন্দী করলে গাছটি আলো বাতাস থেকে বঞ্চিত হয় তেমনি শিশুর ক্ষেত্রে অতি শাসন তাকে উদ্ধৃত ও বেপরোয়া করে। তাই এক্ষেত্রে সমতা বজায় রাখা দরকার। একই সাথে শিশু চরিত্রের মধ্যে বিবেচনাবোধ ও জবাবদিহিতা বৈশিষ্ট্যের অনুপ্রবেশ ঘটানো দরকার। চাওয়া মাত্র শিশুর হাতের কাছে সব পৌঁছে দিলে তার মধ্যে বিবেচনা বোধ জন্মাবে না। শিশু তার যে কোন কাজের জন্যে জবাবদিহি করতে বাবা, মা ও শিক্ষকের কাছে বাধ্য থাকবে। জবাবদিহিতায় অস্বচ্ছতা থাকলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। হতে পারে সেটি মানসিক বঞ্চনা। যেমন মা বাবার স্নেহ ভালবাসার স্পর্শ থেকে কিছু সময় বা কিছুদিনের জন্যে বঞ্চিত করা আবার বস্তুগত কোন জিনিস প্রাপ্তি থেকেও তাকে বঞ্চিত করা যেতে পারে। চলার পথে শিশুকে হোঁচটের মুখোমুখি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে শিশু বার বার আছাড় খেয়ে হাঁটতে শেখে সে পরবর্তীতে যখন পুরোপুরি হাঁটতে শেখে তখন আর তার পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। কিন্তু যে শিশুকে হাত ধরে ধীরে ধীরে হাঁটতে শেখানো হয়, সেই শিশুর হাঁটতে শেখার দৃঢ়তা অর্জনে অনেক বেশি সময় অতিবাহিত করতে হয়। পরিবারে এসব বিষয়ের চর্চা থাকলে শিশু যৌক্তিক বোধ সম্পন্ন হয়ে ওঠে।

বয়ঃসন্ধিকাল শিশুর জীবনে একটি স্পর্শকাতর সময়। রবীন্দ্রনাথের কথায় “১৩-১৪ বছর বয়সের মতো এমন বালাই আর পৃথিবীতে নেই”। এ বয়সে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে শারীরিক পরিবর্তন অতিদ্রুত ঘটে। এ শারীরিক পরিবর্তনের কিছু বাহ্যিক প্রকাশ তাদের দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে। যেমন কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন হয়, দেহের আকার অবয়বে পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে। কারণ ছেলে-মেয়েদের এই বিশেষ সময়কালীন অবস্থায় তাদের দিকে যে দৃষ্টি দিতে হবে এ বিষয়টিই বেশির ভাগ পরিবার জানে না। ফলে এ বয়সী ছেলে- মেয়েরা উপযোজনে সমস্যায় পড়ে। তাছাড়া এটি একটি সন্ধিক্ষণ। এ সন্ধিক্ষণে তারা ভূমিকার দ্বন্দ্বে পড়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ফলে এসময় ছেলে-মেয়েরা বন্ধু-বান্ধবদের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বন্ধু-বান্ধবদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ফলে এ সময়ের সহজাত বৈশিষ্ট্য এ্যাডভেঞ্চার প্রিয়তা, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ, নিত্য নতুন বিষয় জানার আগ্রহ প্রভৃতি বিষয়ে তারা অতি তত্পর হয়ে ওঠে এবং অতি তত্পরতার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে তারা অনেক সময় বিপদের মুখোমুখি হয়। তাই বয়ঃসন্ধিকালের এ বিশেষ পর্যায়ের দিকে লক্ষ্য রেখে বাবা মা ও পরিবারের সদস্যদের হিসেবী আচরণ দিয়ে ছেলে-মেয়েদের মোকাবেলা করা দরকার।

বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তার বন্ধু শ্রেণী বা সমবয়সী দল। এ বয়সী ছেলে-মেয়েরা কাদের সাথে মেলামেশা করছে, যে সময়টুকু বাইরে কাটাচ্ছে সে সময়ে কারা তার সহচর হচ্ছে, কোন এলাকায় তার অবসর সময় অতিবাহিত করছে, অবসরে তারা কী পরিমাণ টাকা পয়সা খরচ করছে, টাকা পয়সা কোথা থেকে পাচ্ছে এ বিষয়গুলো শুরু থেকে বাবা মায়ের নখদর্পণে থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে রোগ পুরাতন হয়ে গেলে তার নিরাময় কষ্টসাধ্য হয়। তাই শুরুতে কোন সমস্যা দেখা দিলে তা সতর্কতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে।

একটি শিশুর বিকাশে পিতা মাতার সাথে সাথে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তার বিদ্যালয় ও শিক্ষক। শিশুদের বিকাশকালীন সময়ের বিভিন্ন চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে সব ছেলে-মেয়েরা বিদ্যালয়ে আসছে তাদের অধিকাংশের মা বাবা শিক্ষিত ও সচেতন নয়। সে ক্ষেত্রে এসব শিশুদের পরিচর্যার মূল দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষকদের ওপর। কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর বাস্তব প্রয়োগ করে দেশাত্মবোধ, গুরুজনে ভক্তি, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, ধর্মভীরুতা এগুলো দৈনন্দিন চর্চার মধ্য দিয়ে তাদের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। পাঠের মূল উপযোগিতা তাদের কাছে মূর্ত করে এগুলোকে আচরণে রূপদান করতে সচেষ্ট হতে হবে।

আজকের শিশুই আমাদের ভবিষ্যত্ কর্ণধার। ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে যোগ্য করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়েই আমরা একটি সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন দেখতে পারি। এ প্রচেষ্টাকে ফলপ্রসূ করার জন্যে শিশু প্রতিপালনে স্নেহ, আদর, শাসন ও নিয়ন্ত্রণের সহনীয় দেয়াল তৈরি করে তাদের যথাযথ বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ, সরকার প্রত্যেকের যথাযথ ভূমিকা পালনের মধ্যে দিয়ে আগামী প্রজন্মকে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারলেই সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন বাস্তবরূপ লাভ করবে।