bondhu-chara-jibon-keno-sombhob-na

বন্ধুহীন জীবন কেন সম্ভব নয়?, দৈনিক বাংলা

জীবনটা সুন্দর হতে, নিছক বন্ধু হয়ে আসা মানুষগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে না, বরং সতর্কতা নিয়ে নিরাপদে মিশতে হবে। আর সত্যিকারে বন্ধুকে যদি পেয়েই যাই, তবে তা সৌভাগ্যের বিষয়।

    সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই জীবনধারণের প্রয়োজনে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন-যাপন করতে শিখেছে। শিখেছে নিজেকে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে নানা সম্পর্কের সূত্রে আবদ্ধ করতে। সেই গোষ্ঠীবদ্ধতা কিংবা নানা মাত্রিক সম্পর্কগুলোর ভিত্তিতে তাই সহজাতভাবে ঢুকে পড়েছে আদান-প্রদান, লেনদেন এবং স্বার্থ। অর্থাৎ কিছু দেব, কিছু নেব- এই সূত্রেই গড়ে উঠেছে মানুষের সম্পর্কগুলো। তবে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষ নিজেকে অন্য সব প্রাণীর থেকে উন্নত করতে পেরেছে বলেই মানুষ সেরা। সেই আদিম যুগ থেকেই মানুষ স্বার্থের অতিরিক্ত সম্পর্কে জড়াতে শিখেছে। কিছু পাব না জেনেও মানুষ দিতে শিখেছে এবং একইভাবে কিছু দেব না জেনেও মানুষ নিতে শিখেছে। অর্থাৎ বাস্তবিক অর্থে লেনদেনের অতিরিক্ত সম্পর্কও মানুষ গড়তে শিখেছে। সেই সম্পর্ককেই আজ আমরা বন্ধুত্ব বা ফ্রেন্ডশিপ বলি।

সত্যি বলতে কি বন্ধুত্বেও একধরনের লেনদেন থেকে থাকে। সেটা একেবারে অদৃশ্য কিংবা অবস্তুগত। সেই লেনদেনের বিনিময় মাধ্যম হলো ভালোবাসা। বন্ধুত্বে দুটো জিনিস অত্যাবশ্যকীয়। এক ভালোবাসা এবং দুই শ্রদ্ধাবোধ। এই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ জন্মের সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে বিশ্বাস ও আস্থার জায়গাটি। অর্থাৎ পারস্পরিক বিশ্বাস এবং একের অপরের প্রতি আস্থা থাকলেই সেখানে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি। এখন বিষয়টা এমন যে, এই ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস কিংবা আস্থা বিষয়গুলোকে আমরা বস্তু দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি না বলেই বন্ধুত্বকে লেনদেনের অতিরিক্ত সম্পর্ক হিসেবে মূল্যায়ন করি।

ওপরের কথাগুলোর আলোকে তাহলে বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা ঠিক কী দাঁড়াচ্ছে? বন্ধুই বা কাকে বলা যায়? একদম সোজাসাপ্টা ভাষায় বললে বলা যায়, বন্ধুত্ব হলো এমন এক সম্পর্ক যেখানে স্বার্থের থেকে পরার্থপরতা গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে নেয়ার থেকে দেয়া বেশি, যেখানে অকৃত্রিম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ মেশানো। আর এই সংজ্ঞার ওপর দাঁড়িয়েই কাকে বন্ধু বলব সেটা ঠিক করে ফেলা যায়। সেই ব্যক্তিই বন্ধু হতে পারবে যে স্বার্থপর নয়, ত্যাগী এবং বিনয়ী। প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক চাণক্য বন্ধু চেনার অনেক উপায় দেখিয়েছেন। আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক সময়ে বহু চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও মোটিভেশনাল স্পিকার বন্ধুত্বের শর্ত, কে বন্ধু কে শত্রু- এমনকি কে বন্ধুরূপী শত্রু ইত্যাদির বিশদ আলোচনা করেছেন। সেসব নিয়ে বিস্তৃত অধ্যয়ন ছাড়াই আমরা খুব সহজে বন্ধু চিনতে পারি। তবে আমরা মানুষ তো, আমাদের ভুল হয়েই যায়। জীবনে প্রতারিত হওয়ার পরও ভেঙে না পড়ে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগোতে হয়।

এ পর্যায়ে বন্ধু হয়ে ওঠার গল্পটা বলি। আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে যদি বন্ধু হওয়ার প্রক্রিয়ার দিকে তাকাই তাহলে দেখব আমরা অধিকাংশই জীবনে প্রথম বন্ধুটিকে পেয়েছিলাম স্কুলে গিয়ে। অবশ্য কেউ কেউ পাড়া প্রতিবেশী হিসেবেও পেয়ে থাকি। আবার স্কুলেও একসঙ্গে অনেকে পড়তাম, বিভিন্ন শ্রেণি ও শাখাতে থাকত শত শত শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে সবাই আবার বন্ধু হয়ে উঠত না। তো স্কুল জীবনের পাওয়া সেই বন্ধুটিকে বন্ধু হিসেবে ভাবার বিশেষ কোনো যৌক্তিকতা ছিল না ছেলেবেলায়। হয়তো একসঙ্গে স্কুলে যেতাম বা পাশাপাশি বসতাম বা তার কোনো একটা বিশেষ দিক ভালো লাগত কিংবা এমনি এমনিই। স্কুলের ওই সময়ে কিন্তু আমরা অনেকের সঙ্গে পড়তাম সবাই কিন্তু বন্ধু হতো না। বলার ক্ষেত্রে এই ভুলটা আমাদের প্রায়ই হয়ে যায় যে একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম, তাই আমরা স্কুল জীবনের বন্ধু। একসঙ্গে স্কুলে পড়ার সূত্রে আমাদের সম্পর্কটা মূলত ছিল সহপাঠী।

সহপাঠী মানেই বন্ধু নয়। যাহোক, স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আমরা কলেজে উঠি, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কর্মজীবন। স্কুলের পরের ক্ষেত্রগুলোতে আমরা বন্ধু বানাই অনেকটা ভেবেচিন্তে। নিজের লাভ-ক্ষতির হিসাব করে। কখনো কখনো ব্যতিক্রম যে ঘটে না, তা না কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিসাব-নিকাশ কষে বন্ধুত্ব করা। প্রথমেই বলেছি, বন্ধুত্বে তো এই হিসাব- নিকাশ চলবে না, বন্ধুত্ব এর উর্ধ্বে। সুতরাং কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুত্ব তাই অনেকাংশেই মেকি বা অসত্য। সে ক্ষেত্রে আমি যেমন বন্ধুত্ব করতে গিয়ে হিসাব-নিকাশে বসেছি, তেমনি অপরজনও তো তা-ই করছে। তাই আমি যেমন বন্ধুর ব্যাপারে সাবধান, আমাকেও তেমনি সাবধান থাকতে হবে বন্ধুত্বের ব্যাপারে।

বর্তমান বিশ্ব ও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক জীবন ব্যবস্থার নিরিখে বন্ধুত্ব নিয়ে চিন্তা করতে গেলেও আমাদের হতাশ হতে হয়। এই চমৎকার সম্পর্কটিও আজ নানাভাবে বিপর্যস্ত। দেখবেন সমাজে একশ্রেণির মানুষ আছে যারা প্রবল সুযোগসন্ধানী, তারা খুঁজে ফেরে তাদের শৈশবের সহপাঠীদের। কে কোন পর্যায়ে আছে, কার কাছ থেকে কী সুবিধা নেয়া যাবে সেই সুযোগের অপেক্ষায় তারা ওত পেতে থাকে। কোনো একজনকে পেলেই ব্যস, আরে বন্ধু বলে জড়িয়ে ধরে, তারপর মুহূর্ত না যেতেই প্রয়োজনের ফিরিস্তি। আরেক দল আছে বেছে বেছে বন্ধুত্ব করে,

সেই বাছবিচারে মাপকাঠি অর্থকড়ি কিংবা সামাজিক- রাজনৈতিক ক্ষমতা। অর্থাৎ যার অর্থনৈতিক সক্ষমতা আছে, যার বাবা কিংবা মামা-চাচার ক্ষমতা আছে তাকেই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে এই শ্রেণি। সবচেয়ে ভয়ংকর শ্রেণিটি হলো বন্ধুরূপী শত্রু। এরা আপনাকে আসলে মোটেই পছন্দ করে না, আপনার ক্ষতি চায় এবং আপনাকে ঘৃণা করে কিন্তু আপনার সামনে তারা প্রকাশ করে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ। এরা এমন চতুর যে বন্ধু হিসেবে এদের শ্রেষ্ঠ মনে হয়।

কী? জটিলতায় ফেলে দিলাম? না, মোটেই না। এই বাস্তবতা নিয়েই তো আমাদের জীবন। বন্ধুহীন জীবন কিন্তু সম্ভব নয়। বরং সভ্যতার অগ্রগতিতে বন্ধুহীন মানুষগুলো বড্ড পিছিয়ে পড়ে। জীবনের প্রয়োজনে, ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে আপনাকে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, অনেক ধরনের সম্পর্কে যুক্ত হতে হবে এবং তার মধ্যে বন্ধুও থাকতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা খেলার মাঠ বা গানের স্কুল- সর্বত্রই আপনার বন্ধুর প্রয়োজন। এমনকি কর্মক্ষেত্রেও বন্ধু লাগে।

তাহলে বন্ধু কীভাবে হবেন? কাকে বন্ধু হিসেবে নেবেন? নিজের স্বার্থ উজাড় করে দিয়ে যেমন বন্ধু হওয়া এই বর্তমান বিশ্বে আপনার পক্ষে সম্ভব না, তেমনি আপনার বন্ধুটির পক্ষেও তো সম্ভব না। তাই প্রথমত আপনাকে নিজেকে বন্ধু হিসেবে যোগ্য করে তুলতে হবে। সেক্ষেত্রে নিজেকে স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা করবেন। তার কাছে গিয়েই বন্ধু হয়ে উঠবেন যাকে আপনার ভালো লাগে, যার মঙ্গল আপনি কামনা করেন, যার উপকার তেমন একটা করতে না পারলেও কোনো দিন ক্ষতি করবেন না, যাকে সুপরামর্শ দেবেন, যাকে ভালোবাসেন ও অন্তর থেকেই শ্রদ্ধা করবেন। নিজেকে ভালো বন্ধু হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে দেখবেন আপনিও ভালো বন্ধুদের দেখা পাচ্ছেন। পৃথিবী যতই রূঢ় হোক, এখনো অন্যায়ের থেকে ন্যায় বেশি, মন্দের থেকে ভালো বেশি এবং শত্রুর থেকে বন্ধুত্ব বেশি।

স্কুল থেকে শুরু করে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অসংখ্য বন্ধুই আমাদের হয়। আমরাও অনেকের বন্ধু হয়ে উঠি। কিন্তু সত্যিকারে বন্ধু, নিঃস্বার্থ বন্ধু পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। যে ব্যক্তি অন্তত একজন প্রকৃত বন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়েছেন, নিঃসন্দেহে তিনি সৌভাগ্যবান। প্রকৃত বন্ধু পাওয়ার মতো নিজেকেও কারও প্রকৃত বন্ধু হিসেবে গড়ে তুলতে পারাটা তো কম সৌভাগ্যের কথা না। বন্ধুহীন জীবন সম্ভব নয়, জীবনে চলার পথে হাজারও রকমের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হবে, তাদের কেউ কেউ বন্ধুও হয়ে উঠবে। অবসরে, বিনোদনে কিংবা ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে, মন খারাপের দিনে কথা বলার জন্য অনেকেই আসবে, তাদের মধ্যে কে বা কারা আমার জন্য নিরাপদ, কাদের সঙ্গে আমি একটু ঘনিষ্ঠ হতেই পারি- সেই বিচার-বিবেচনাটুকু ও সতর্কতাটুকু আমাদের রাখতেই হবে। তবে জীবনটা সুন্দর হতে, নিছক বন্ধু হয়ে আসা মানুষগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে না, বরং সতর্কতা নিয়ে নিরাপদে মিশতে হবে। আর সত্যিকারে বন্ধুকে যদি পেয়েই যাই, তবে তা সৌভাগ্যের বিষয়।

লেখক: ড. ইয়াসমীন আরা লেখা
উপ-উপাচার্য, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়

Original Link