শিশুদের শিক্ষার ভিত রচনা করে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা। এ স্তর থেকে ভিত্তি শক্তিশালী করে শিশুরা অন্যান্য স্তরে প্রবেশ করে। সম্প্রতি শিক্ষার ভিত রচনাকারী দেশের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে নানাধরণের নেতিবাচক সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও বিদ্যালয় দখল করে মাজার গড়ে উঠেছে, কোথাও বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ দখল হয়ে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ময়লার ভাগাড় ও হাঁটবাজার গড়ে উঠেছে এবং অনেক বিদ্যালয়ের সামনে হাঁস-মুরগির বাজার থাকার কথাও শোনা যাচ্ছে। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে দরজা জানালা নেই। পর্যাপ্ত শিক্ষক থাকলেও শিক্ষার্থী নেই। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এই দৈন্যদশার চিত্র আমাদের ভাবিয়ে তোলে। যে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যত সুনাগরিক গড়ে ওঠার কথা সেখানে এতো সমস্যা থাকলে লেখাপড়া বিঘ্নিত হবে সেটা নিশ্চিত। আর লেখাপড়া বিঘ্নিত হলে দেশের ভবিষ্যত প্রজš§ কতটা সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত। এরাই ভবিষ্যত বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে। ভবিষ্যত বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। কিন্তু একশ্রেণীর মানুষ শিশুদের ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। জাতির ভবিষ্যত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই দুষ্টচক্রকে এখনই রুখতে হবে ।

প্রায় বছর খানেক আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সমীক্ষায় জানা গেছে, রাজধানীর ২৯৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫৪টি বিদ্যালয়ের জমি ও ভবন, শ্রেণীকক্ষসহ বিভিন্ন স্থাপনা দখল করে রেখেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রভাবশালী মহল ও সংগঠন। এর মধ্যে ৭টি বিদ্যালয়ের জমিতে ওয়াসার পাম্প, কমিউনিটি সেন্টার, গ্যারেজ, দোকান ও ক্লাবঘর থেকে শুরু করে আনসার বাহিনীর কার্যালয় রয়েছে বলে সমীক্ষায় জানা গেছে। কোনো কোনো বিদ্যালয়ের জমিতে গড়ে উঠেছে কাঁচাবাজার, মসজিদ ও ঈদগাহ। বস্তিবাসী থেকে শুরু করে অবাঙালিরাও দখলে রেখেছেন কয়েকটি বিদ্যালয়ের জমি।

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে এই সঙ্কট থেকে মুক্ত করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার পরিদর্শন শুরু করেছেন। পুরানো ঢাকায় ১২টি জরাজীর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয় চিহ্নিত করে তিনি গত ২৪ আগস্ট ৫টি পরিদর্শন করেছেন। জরাজীর্ণ ইসলামিয়া ইউপি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশু রক্ষা সমিতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফরিদাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাংলাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে নানা সঙ্কটের কথা জানতে পেরেছেন মন্ত্রী। পরদিন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, পুরনো ঢাকার ইসলামিয়া ইউপি সরকারি প্রাথমিক স্কুল মাজার তৈরি করেছে দখলবাজরা। তাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত প্রধান শিক্ষক শাহনাজ পারভীনকে দখলবাজ বলে প্রধান আসামি করে মামলা করেছে ঐ চক্রটি। বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে কটূক্তি করে এবং ভবনের সিড়িতে ময়লা ফেলে পথ অবরোধ করে শাহনাজ পারভীনকে দমন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে দখলবাজরা। সন্তানকে বিদ্যালয়ে না পাঠাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের হুমকি দিয়ে বিদ্যালয়ের জায়গাটি দখলের সর্বাতœক অপচেষ্টা চালাচ্ছে দখলবাজ চক্র।

এটি শুধু ইসলামিয়া ইউপি সরকারী প্রথামিক বিদ্যালয়ের চিত্র নয়। এরকম শত শত বিদ্যালয় রয়েছে সারা দেশে। দিনের পর দিন এসব সমস্যা নিয়ে সংবাদপত্র বা মিডিয়া কমবেশী সোচ্চার হলেও শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে দখলবাজদেরই জয়ী হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এরকম বহুবিধ সমস্যা ও সঙ্কটে রাষ্ট্রের ভবিষ্যত কর্ণধারদের বিকাশ বিঘ্নিত হচ্ছে। অথচ শিক্ষা মৌলিক অধিকারের একটি। বর্তমান সরকারও শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এ সরকারের বহুবিধ অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্যের পরিমাণও উল্লেখ করার মতো। এই যে সাফল্য সেটিকে স্থায়ী করতে হলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘিরে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে সেগুলোর নিরসন জরুরি। দখলবাজ যতই প্রভাশালী হোক না কেন তাকে শিক্ষা প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য শাস্তি দেয়া প্রয়োজন।

সংকট নিরসনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী আশার আলো জ্বেলেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দখল হওয়া জায়গা মুক্ত করতে শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হবে। এসময় তিনি বলেন, ঢাকার জরাজীর্ণ ১২ সরকারি প্রাথমিক স্কুলের সংস্কারের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ স্কুলগুলো চলতি অর্থ বছরেই সংস্কার করে শিক্ষার স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হবে। এ জন্য বিশেষ বরাদ্দও দেয়া হবে। শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রীর এ ধরণের কথা আমাদের আশস্ত করে। আমাদের প্রত্যাশা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী তার কথা রাখবেন। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দখলবাজমুক্ত করবেন। দখলবাজ চক্র যতই শক্তিশালী হোন না কেন সরকার তাকে ছাড় দেবে না সে আশা করছে দেশের মানুষ। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার বসবাসকারীদেরও একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে। আইন-শৃংখলা বাহিনীসহ প্রশাসনকেও এগিয়ে আসতে হবে। আর যদি স্থানীয় তরুণ সমাজ এগিয়ে আসে তাহলেতো কথাই নেই। পুরানো ঢাকাসহ দেশের যে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে সেগুলোতে অবিলম্বে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে চাই সবার সমন্বিত উদ্যোগ। আমরা সবাই যদি যার যার অবস্থান থেকে ভবিষ্যত প্রজšে§র বিকাশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই শুরু করতে পারি তাহলে প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গন হয়ে উঠতে পারে সঙ্কটমুক্ত। শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসার এখনই সময়। সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তার সঙ্গে সবাইকে একাট্টা হয়ে লড়াই করতে হবে। আমাদের সন্তানদের জন্য আমরা সে লড়াই থেকে দূরে সরে থাকলে ভবিষ্যত প্রজšে§র কাছে আমাদেরকেই জবাবদিহি করতে হবে।

অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন আরা লেখা

উপ-উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি