জলবায়ুর পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বে একটি মারাত্মক হুমকিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশসহ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। উন্নত বিশ্বের শিল্পকারখানার কারণে বিশ্বজুড়ে বেড়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা। গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ায় বাতাসে সিসার মাত্রা বেড়ে যাওয়া, সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ পানির লেভেল ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়াসহ ওজন স্তর ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে বিশ্বজুড়েই দুর্যোগের মাত্রা ও পরিমাণ বাড়ছে। ভূমিকম্প, ভূমিধস, খরা-বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষ। উন্নত বিশ্বের শিল্পমুখীনতার প্রভাবে এসব দুর্যোগের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বিষয়টি ব্যাপক গুরুত্ব পায়। পরপর কয়েকটি জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের, আরো স্পষ্ট করে বললে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এসব সম্মেলনে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষুরধার যুক্তি উত্থাপন ও যোগ্য নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনগুলোতে উন্নত দেশগুলো, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ইতালি ও ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশ পরিবেশের সুরক্ষায় তহবিল গঠনে সম্মত হয়। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়, এই তহবিলের বড় অংশই ব্যয় হবে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে।

বিশ্বজুড়ে পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসিত হচ্ছে। একই সঙ্গে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় আবারো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার উদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘের ‘চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ’ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। চলতি বছর ‘পলিসি লিডারশিপ’ ক্যাটাগরিতে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক এই সর্বোচ্চ পুরস্কারের জন্য শেখ হাসিনার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। নিউইয়র্কে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয়ার কথা রয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগদান উপলক্ষে ওই সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করবেন।

এ বিষয়ে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) জানায়, প্রতিবেশগতভাবে ‘নাজুক অবস্থায় থাকা’ বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘সামগ্রিক পদক্ষেপের স্বীকৃতি’ হচ্ছে এই পুরস্কার। উল্লেখ্য, পরিবেশ নিয়ে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৪ সাল থেকে প্রতি বছর চারটি ক্যাটাগরিতে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ পুরস্কার দিয়ে আসছে ইউএনইপি। চলতি বছর শেখ হাসিনা ছাড়াও ‘ইন্সপিরেশন এন্ড একশন’ ক্যাটাগরিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বন্যপ্রাণী রক্ষাকর্মীদের দল ব্লু্যাক মামবা এপিইউ, ‘সায়েন্স এন্ড ইনোভেশন’ ক্যাটাগরিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি, ‘এন্টারপ্রেনারিয়াল ভিশন’ ক্যাটাগরিতে ব্রাজিলের প্রসাধনী প্রস্তুতকারক কোম্পানি নেটুরা এ পুরস্কার পাচ্ছে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশের প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা স্বীকৃত আমাদের জন্য আনন্দের। আমাদের জানা আছে, গ্লোবাল ভিলেজ কনসেপ্টের জন্য পুরো পৃথিবী এখন প্রায় এক ছাতার নিচে অবস্থান করছে। বিশেষ করে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও পরিবেশ ইস্যুতে এখন প্রায় সারাবিশ্ব এক সুতোয় গাঁথা। অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্বের সব দেশগুলো কমবেশি এক সুতোয় গাঁথা আগে থেকেই। গত প্রায় দুই যুগে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও পরিবেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র বা এর প্রধানমন্ত্রীর এরকম একটি অর্জন আমাদের সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা জোগায়।

নিজের বা সরকারের কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুরস্কার প্রাপ্তি নতুন কিছু নয়। এর আগেও তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের (এমডিজি) অংশ হিসেবে শিশুমৃত্যু হার কমানোয় সাফল্যের জন্য জাতিসংঘের পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (এফএও) কর্তৃক ‘সেরেস পদক’ লাভ করেন তিনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো শেখ হাসিনাকে ১৯৯৮ সালে ‘ফেলিক্স হুফে বইনি’ শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। আমাদের মহান শহীদ দিবস বা একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আজ সারা বিশ্বে যে উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হচ্ছে তার পেছনেও শেখ হাসিনার অবদান উল্লেখ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি, জাপানের ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ বিশ্বের একাধিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শেখ হাসিনাকে ডক্টর অব ল’জ উপাধি প্রদান করেছে। ২০০৫ সালে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শান্তির স্বপক্ষে অবদান রাখার জন্য শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি অব রাশিয়া। এরকম অসংখ্য অর্জন রয়েছে শেখ হাসিনার, যা আমাদের গৌরবান্বিত করে।

শেখ হাসিনার মতো একজন নেতা বা প্রধানমন্ত্রীর এই অর্জন পুরো বাংলাদেশকেই সম্মানিত করে। এই বিশ্বাস দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক মহলে সাধুবাদ পেলে তা আরো বেশি আনন্দদায়ক হতো। একটি দেশের সরকার প্রধান যখন কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পান তখন সেটি পুরো দেশের। সে কারণে সেই অর্জনের আনন্দ সবাই ভাগাভাগি করে নিলে পুরো দেশই উপকৃত হয়। আন্তর্জাতিক মহলও আমাদের রাজনৈতিক ঐক্যে আপ্লুত হতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক যে, আমাদের এ ধরনের অর্জনে সবাই ভাগাভাগি করে নেয়ার সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। কিন্তু শেখ হাসিনা তার অর্জনকে জনগণের জন্য বরাবরই উৎসর্গ করে প্রমাণ করেন তার জীবনে দেশের জনগণের অবস্থান কোন পর্যায়ে। জনগণের প্রতি তার এই মমত্বকে আমরা যদি সর্বাত্মকভাবে সাধুবাদ জানাতে পারতাম তাহলে দেশের জন্য নিবেদিত প্রধানমন্ত্রী যেমন উৎসাহ পেতেন তেমনি তার কাজের গতিও বাড়তো।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ও পদক্ষেপের কোনো অভাব নেই। বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিতকরণে তিনি যেমন দেশের অভ্যন্তরে নানা ভূমিকা রাখছেন তেমনি জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করতে সব সময় সক্রিয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন গত সরকারের আমলে দেশে জলবায়ু ট্রাস্ট গঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বে জলবায়ু বিষয়ক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের নেতৃত্বদান শেখ হাসিনার বিচক্ষণতার প্রমাণ দেয়।

পরিবেশ রক্ষায়ও শেখ হাসিনার পদক্ষেপের কথা সর্বজনবিদিত। সরকারে থাকুন আর না থাকুন, বৃক্ষ রোপণে শেখ হাসিনার যে উৎসাহ এবং বৃক্ষ নিধন রোধে যে পদক্ষেপ তা আশাব্যঞ্জক। প্রতিটি নাগরিকের বাড়ি ও আশপাশে একটি করে বনজ, ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষ রোপণের যে আন্দোলন আজ দৃশ্যমান তার শুরুটা কিন্তু শেখ হাসিনাই করেছেন। বৃক্ষমেলা ও বৃক্ষরোপণ সপ্তাহে গাছের প্রতি মানুষের যে মমত্ব দেখা যায়, তার জন্যও প্রশংসার দাবি রাখেন শেখ হাসিনা। শুধু কি বৃক্ষ বা গাছ- আজ দেশে খাল-বিল, নদী-নালা, জলাধার সংরক্ষণে যে আন্দোলন চলছে তা এগিয়ে নেয়ার জন্য কমবেশি কৃতিত্ব কিন্তু শেখ হাসিনার রয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি আজ যতটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে তার জন্যও শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ দিতে হয়। দেশব্যাপী নদী বা খাল উদ্ধারে বা জলাধার নিশ্চিতকরণে শেখ হাসিনাই সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে কঠোর নির্দেশ দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেষ্ট রয়েছেন।

শেখ হাসিনার এ পুরস্কার প্রাপ্তির পর ইউএনইপির নির্বাহী পরিচালক অচিম স্টেইনার তার বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উচ্ছ¡সিত প্রশংসা করেছেন বলে জানা যায়। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘বেশ কয়েকটি উদ্ভাবনমূলক নীতিগত পদক্ষেপ এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ তার উন্নয়নের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। জলবায়ু অভিযোজন কর্মসূচির অগ্রগামী বাস্তবায়নকারী এবং অভিযোজন নীতির পক্ষের বলিষ্ঠ প্রবক্তা হিসেবে শেখ হাসিনা অন্যদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।’ আর বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিনস বলেছেন, বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করতে পেরেছে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে বা জলবায়ু বিষয়ে শেখ হাসিনার পুরস্কার প্রাপ্তিতে ভিনদেশিরা যে প্রশংসা বা মন্তব্য করেছেন তার সঙ্গে আমাদের সবারই সম্পৃক্ত হওয়া উচিত ছিল। আমরা কি এই অর্জনকে অভিনন্দন জানিয়ে এক ভিন্ন আবহ সৃষ্টি করতে পারি না? তবে শেখ হাসিনার এই প্রাপ্তিতে উৎসাহিত হয়ে অবলীলায় বলা যায় ‘জয়তু শেখ হাসিনা’।

প্রফেসর ড. ইয়াসমীন আরা লেখা : উপ-উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি।