ঈদ বা বন্যা ইত্যাদি কোনো না কোনো ইস্যু সামনে রেখে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। বেশ কিছুদিন থেকে চালের বাজার অস্থির রেখে সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট চক্র দেদারসে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এ নিয়ে সরকার কঠোর হয়ে নানা ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বাগে আনতে পারছে না মুনাফালোভী চাল ব্যবসায়ীদের। এখনো আগের চেয়ে বাড়তি দামে চাল কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ঈদের সময় লবণের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা চলেছে। ঊর্ধ্বমুখী জিরা, এলাচসহ রান্নার অন্যান্য মসলার দামও। সয়াবিন তেলের দামও আগের চেয়ে বেড়েছে। এর পাশাপাশি সব ধরনের সবজি ও মাছের দাম বেড়েছে। বাজারে সংকট বা ঘাটতি না থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা এ অপকর্ম অব্যাহতভাবে করে চলেছে।

সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারদর জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালালেও কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারণে তা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজনের গাফিলতির কথা শোনা যায়। অভিযোগ আছে উদ্যোগ নেওয়া হলেও কখনো কখনো তা মাঝপথে থেমে যায়। আবার নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবের কথাও জানা যায়। যার ফলে দায়ী ব্যবসায়ীরা যেমন পার পেয়ে যান, তেমনি আবার একই ধরনের অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক উত্সবের সময় এদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি শ্রেণি অতি মুনাফার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ সময় তাদের কাছে ধর্মীয় নির্দেশনা বা দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়। কীভাবে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়া যায়, সে চেষ্টাই মুখ্য হয়ে ওঠে। আর মুনাফালোভী এই ব্যবসায়ীদের লোভের জাঁতাকলে পিষ্ট হয় দেশের কোটি কোটি মানুষ। এক্ষেত্রে সরকার বা সংশ্লিষ্ট বিভাগ যেন অসহায়। আর ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলো সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে। এ বিষয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি পাইকাররা দাম বাড়ানোতে তাদেরও দাম বাড়াতে হয়েছে। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্যাসহ নানা কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সেসব পণ্য বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ফলে তাদেরকেও বেশি দামে বাজারে সরবরাহ করতে হচ্ছে। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ একটু দূরদর্শী ও সতর্ক হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের এ ধরনের অপকর্ম থেকে জনগণ রক্ষা পেতে পারে।

আমরা সবাই ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কথা জানি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য জনগণের নাগালের মধ্যে রাখতে এই প্রতিষ্ঠানটি গঠন করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে যেন প্রতিষ্ঠানটিও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুসারে ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ভেজাল বিরোধী কার্যক্রমে আংশিক সফল হলেও এর কার্যক্রম জোরদার করা উচিত। কখনো কখনো বাজারে সংকট সৃষ্টি হলে প্রতিষ্ঠানটি যে দ্রব্য বা পণ্য নিয়ে সংকট চলে সেটি আমদানি করে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করে। তবে টিসিবির পণ্য বাজারে আসতে আসতেই মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা তাদের কাজটি সেরে ফেলেন। ফলে জনগণ এর সুফল ভোগ করতে পারে না। তবে এই প্রতিষ্ঠানটি এখনও জনগণের জন্য কাজ করে নিজেদের ভাবমূর্তি যেমন আরও উজ্জ্বল করতে পারে তেমনি সরকারের প্রতিও জনগণের আস্থা বাড়াতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী উদ্যোগ, নজরদারি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

বাজারে কখন কোন্ পণ্যের চাহিদা বেশি এবং কোন্ কোন্ পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করতে পারে, সে অনুযায়ী টিসিবি সংকট তৈরি হওয়ার পূর্বেই এ পণ্য আমদানি করে স্টক করে রাখতে পারে। দেশি পণ্যের ক্ষেত্রে দেশের বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ করে তা স্টক করা যেতে পারে। বিষয়টি সবারই জানা যে, রোজার ঈদে সেমাই, চিনি, দুধসহ সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম নিয়ে কারসাজি করে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। আর কোরবানির ঈদে পেঁয়াজ, মরিচ, হলুদ, লবণ, মসলাসহ সংশ্লিষ্ট দ্রব্যাদির দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। বিষয়টি টিসিবিরও অজানা নয়। তাহলে বছরের শুরুতে একটি পরিকল্পনা করে কেন টিসিবি এসব পণ্য আমদানি বা সংগ্রহ করতে পারছে না?

এবারে আসা যাক সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও ব্যবসায়ী বিভিন্ন সংগঠনের কথায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে যে ব্যবসায়ীরা জনগণকে সংকটে ফেলেন তাদের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ক’টি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে? সংকটকালে যেভাবে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা, শেষ পর্যন্ত সে ঘোষণার বাস্তবায়ন খুব একটা লক্ষ করা যায় না। দেশে আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবসায়ী মনে রাখার মতো একটি শাস্তি পেয়েছে? কিন্তু ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের বক্তব্য-বিবৃতিতে মনে হয়, অপকর্মকারী কোনো ব্যবসায়ী ছাড় পাবেন না। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোই বা জনগণের ভোগান্তির জন্য দায়ী মুনাফালোভী কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন? এই সংগঠনগুলোর কি কোনো দায় নেই জনগণের প্রতি?

বিষয়গুলো ভাবা খুবই প্রয়োজন। যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে চলেছে তার জন্য শেষ পর্যন্ত দায় কিন্তু সরকারের ওপরই বর্তাবে। অথচ নিশ্চিত করে বলা যায়, বর্তমান সরকার জনকল্যাণমুখী একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারের ভূমিকা অতুলনীয়। তারপরও এ সংকট কেন? কেন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকলে পড়ে সরকার সমালোচনার মুখে পড়বে সেটি ভেবে দেখা দরকার। এ থেকে রক্ষা পেতে সরকার, সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর একযোগে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। সবাই মিলে যদি মুনাফালোভী চক্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন—তাহলে পরিস্থিতি পাল্টাতে বাধ্য।

 লেখক :উপ-উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি