শারীরিক প্রতিবন্ধী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিষয়ে আমরা কিছুটা অবগত হলেও ‘অটিজম’ (Autism) শব্দটির সাথে আমরা খুব বেশি পরিচিত নই। ছোট এই শব্দটির গভীরতা এত বেশি যার ব্যাপকতা সম্পর্কে আমাদের জানা অত্যন্ত জরুরি।
অটিজম মস্তিষ্কের একটি স্নায়ুবিক সমস্যা যা মস্তিষ্কের সাধারণ কর্মক্ষমতাকে ব্যাহত করে। অটিজম শব্দটির বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় নিজের মধ্যে মগ্ন থাকা। অটিজম শিশুরা একা একা  নিজের মনে, নিজের জগতে বিচরণ করে। তারা কারও সাথে কথা বলে না, তাদের চাহনি কিছুটা অস্বাভাবিক ও অন্যের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয় না,  নিজের  চাওয়া পাওয়া নিয়ে কারও সাথে আলোচনা  করে না, মাকে জড়িয়ে ধরে না কিন্তু যে কাজগুলো করে তা বার বার করতে থাকে। অর্থাত্ পুনরাবৃত্তিমূলক  আচরণ করে। এছাড়া অতি চাঞ্চল্য (Hiper Activity), জেদি ও আক্রমণাত্মক (Aggressiveness)  আচরণ, অহেতুক ভয়ভীতি, খিঁচুনি  ইত্যাদিও এসব শিশুদের মধ্যে থাকতে পারে। এই শিশুদের বিশেষ কিছুর প্রতি অত্যাধিক আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায় যেমন- কাগজ  ছেঁড়া, পানি বা তরল পদার্থ দিয়ে খেলা, চাল, ডাল দানাদার কিছু দিয়ে খেলা আলোতে চোখ বন্ধ করা, শব্দ শুনলে  কানে হাত দেয়া, দুর্গন্ধে কোন প্রতিক্রিয়া না করা, স্বাদ ও  স্পর্শে তেমন  অভিব্যক্তি প্রকাশ  না করা ইত্যাদি। শিশুর জন্মের তিন বছরের মধ্যেই অটিজম শিশুদের উল্লেখিত লক্ষণের কোন না কোনটি প্রকাশ পায়। অনেক ক্ষেত্রে আঠার মাস বা জন্মের পর থেকেই শিশুর আচরণ অস্বাভাবিক মনে  হতে পারে।

অটিস্টিক শিশুরা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শী হয়। তাই এই ধরনের শিশুদের বিশেষ প্রয়োজন সম্পন্ন শিশু বা বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদা সম্পন্ন শিশু বলা হয়। তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা প্রায় স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে বিধায় এদের সম্পূর্ণ প্রতিবন্ধী হিসেবে আখ্যায়িত করা সঠিক নয়। পরিবারে একটি শিশুর আগমন নিয়ে আসে সীমাহীন আনন্দ বার্তা। কিন্তু সেই শিশুর মাঝে যদি সামান্যতম অস্বাভাবিকতা দেখা দেয় তা ঐ পরিবারের জন্য আনন্দের পরিবর্তে তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই শিশুটিও যে বিশেষ সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারে, একদিন বড় হয়ে কোন একটি বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী হতে সক্ষম এই ব্যাপারটি সম্পর্কে আমাদের অনেকের ধারণাই নেই। আমাদের সমাজে বিশেষ এই শিশুদের সক্ষমতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় আমরা এই কষ্টকে বহু গুণে বাড়িয়ে তুলি। প্রথমেই শিশুটিকে সমাজ থেকে আড়াল করার মাধ্যমে শুরু করি তার সাথে নেতিবাচক আচরণ। নেতিবাচক আচরণ ও পরিবারের অবহেলায় শিশুটির সামাজিক বিকাশে বিঘ্ন ঘটে। বিশেষ করে তাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করতে হবে তা না জানার জন্যই আমরা তাদের সাথে ভুল আচরণ করি। ফলে তারা যে জটিলতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে তা আরও জটিলতর হয়ে উঠে। তারা আত্মকেন্দ্রিক হয়, সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে পারে না, খিটখিটে মেজাজের হয় এবং ক্রমেই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-মা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না যে শিশুটি আদৌ অটিস্টিক কিনা? বস্তুত,প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে বাবা-মাকেই। কোন বাবা-মাকে হতাশ হলে চলবে না। শিশুর কোন অস্বাভাবিকতা যেমন: নিজের নাম শুনে না তাকালে, শিশু ব্যাবলিং শব্দ গুলো না করলে, এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে কোন কিছু নির্দিষ্ট করে না দেখালে, কথা বলার সময় চোখে চোখ না রাখলে, কেউ কিছু দিলে তা না ধরলে বা ধরলেও পড়ে গেলে ও নিজের পছন্দের বস্তু নিয়ে অন্যের সাথে অংশগ্রহণ না করলে অবশ্যই তাকে অটিজম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে। স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় তাদের প্রতি একটু বেশি নজর দিতে হবে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত চিকিত্সা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাদের সাথে এমন কোন আচরণ করা যাবে না যাতে করে তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মনে রাখতে হবে যত দ্রুত অটিস্টিক শিশুকে সনাক্ত করা যায় এবং যত তাড়াতাড়ি শিশুকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে সম্পৃক্ত করা যায় তত দ্রুত তার উন্নতি করা সম্ভবপর হবে। অটিস্টিক শিশুর বাবা মায়ের জন্য একটি আশার সংবাদ এই যে, বেশির ভাগ অটিস্টিক শিশু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়। প্রতি ১০ জন অটিস্টিক শিশুর মধ্যে একজনের ছবি আঁঁকা, গানে, গণিতে বা কম্পিউটারে অসাধারণ দক্ষতা ইত্যাদি থাকতে পারে। এই সব শিশুদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে সে হয়ে উঠতে পারে দেশের অমিত সম্ভাবনা। তাই হতাশ না হয়ে ভবিষ্যত্ সম্ভাবনাকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে আপনার শিশুটিও একদিন হয়ে উঠতে পারে একজন মহাবিজ্ঞানী, নামকরা অংকন শিল্পী, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, গণিত বিশারদ বা দক্ষ ক্রীড়াবিদ।
সম্প্রতি সায়মা ওয়াজেদ তার প্রকাশিত একটি নিবন্ধে (School Psychologist) স্কুল মনোবিজ্ঞানী নামে একটি নতুন ধারণা উল্লেখ করেন। এ ধারাণাটি বাংলাদেশে একেবারেই নতুন বলা যায়। আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেনসহ মোট ৪৮টি দেশে স্কুলে মনোবিজ্ঞানী কাজ করছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই পেশাটি মূল ধারায় এখনও আনা সম্ভব হয়নি। তিনি বাংলাদেশে এই পেশাটি মূল ধারায় আনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।তিনি স্কুল মনোবিজ্ঞানীর কার্যক্রম কি হবে সে সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেন। সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্কুলে স্কুলে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেয়া হলে হলে আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। ফলে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশু ও যুবকদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে যেমন খুবই ইতিবাচক দিক হবে তেমনি আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই সরকারের কাছে আমাদেরও জোর দাবি থাকবে এই বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করে অর্থাত্ প্রতিটি স্কুলে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ করে বাংলাদেশে অটিজমসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুদের মূল ধারায় নিয়ে আসার।
তবে আশার সংবাদ—বাংলাদেশের বর্তমান সরকার অটিজমসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করার ক্ষেত্রে খুবই আন্তরিক। যার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। গত ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পাঁচ জাতির আইসিআরসি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয় এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এ টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধী জনগণ সামাজের সকল স্তরে অবদান রাখছে। তারা কেন বাইরে  পড়ে থাকবে?  তাদের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে হবে।’ প্রতিবন্ধীরাও যে  চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা  করে একটি দেশের জন্য, জাতির জন্য সম্মান বয়ে আনতে পারে, তার প্রমাণ বিশেষ  অলিম্পিক ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আয়োজিত ক্রিকেট টুর্নামেন্টে তারা রেখেছে। উল্লেখ্য, “বিশেষ অলিম্পিকে আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা ২১টি স্বর্ণসহ ৭০টি পদক নিয়ে এসেছে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা ক্রিকেট  খেলায় তাদের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছে।”
 লেখক :উপ-উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি